leadT1ad

৫ আগস্ট ২০২৪, স্পট: ডিবি কার্যালয়

‘আসতেছে, মাইরা ফেলাবে এখন’, ভাসে আজও তৈয়বের কানে

গত বছর ৫ আগস্ট যখন হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে উত্তাল দেশবাসী ঢাকায় জমায়েত করছিলেন, সেদিন সকালবেলায় সবার মতো বেরিয়েছিলেন তৈয়ব। কিন্তু তাঁকে মাঝরাস্তায় মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডিবি কার্যালয়ে। কি ঘটেছিল সেখানে?

শতাব্দীকা ঊর্মি
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৫৯
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৫৩
৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে তৈয়ব। ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

‘রমনার মোড়ে পথ আটকে মারধরের পর পুলিশ তুলে নিয়ে গেল ডিবি কার্যালয়ে। গিয়ে দেখলাম, আমার সিরিয়াল নং ২৮… তিনটা রুম ছিল ভেতরে। একটা ছিল এমনি ঘর, একটা বাথরুম আর একটা নির্যাতনের রুম। প্রথম দফার মার খেয়ে, রুমে ঢুকেই ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছিলাম…।’ কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তৈয়ব ইসলাম। মোবাইল ফোনে কথাগুলো যখন বলছিলেন তিনি, তখনও যেন তাঁর গলায় আতঙ্কের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল।

গত বছরের ৫ আগস্ট সকালবেলা সারা দেশের মানুষ যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পতনের এক দফা দাবি নিয়ে ঢাকামুখী হচ্ছিল, তখনই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা কলেজের এই শিক্ষার্থীকে। ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমাতে কঠোর পরিকল্পনা ছিল সরকারের। সেনাবাহিনী জানলেও পুলিশ জানত না যে ৫ আগস্ট হাসিনার পতন অনিবার্য। দেড় দশকের স্বৈরশাসনের শেষ দিনে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ছিল আতঙ্ক, বাঁধভাঙা সাহস আর মুক্তির তীব্র বাসনা।

‘অল্প আলোর ওই ঘরে বোঝা যাচ্ছিল না ঠিক কতখানি বেলা।’ ক্ষুধার্ত তৈয়ব মৃত্যুর নিয়তি মেনে নিয়ে নির্ভার হওয়ার পরিহাসে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘হারুনের ভাতের হোটেল কই? ক্ষুধা লাগসে।’ এর মধ্যেই হঠাৎ গুঞ্জন উঠল, ‘হাসিনা পলাইছে।’

৪ আগস্ট শেখ হাসিনা চার বাহিনীর প্রধানসহ পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব আয়োজনই ছিল ৫ আগস্টের কর্মসূচিকে নস্যাৎ করতে। তবু দমানো যায়নি তৈয়বদের।

তৈয়ব জানান, ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ এলাকা থেকে সকালবেলা রওনা দিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আকাশসহ অন্যরা। আগের রাতেই পুলিশের নজর এড়িয়ে তাঁরা এসেছিলেন তৈয়বের বাসায়। ৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তৈয়বের গলা যেন খানিকটা নেমে এল। বললেন, ঘুরপথে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছিলেন তাঁরা। এ সময় লুকিয়ে ফেলেছিলেন নিজেদের স্মার্টফোনগুলোও। তাঁদের লক্ষ্য ছিল শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া। পথেই পরিকল্পনা করলেন, এক সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। কেউ একজন আটক হলেও বাকিরা যাতে কর্মসূচিতে যেতে পারে, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। দুটি আলাদা রিকশা নিয়ে রওনা দিলেন তাঁরা।

শাহবাগে ঢোকার আগে ঠিক রমনা পার্ক মোড় ঘুরতেই পুলিশ আটকালো তৈয়ব আর আকাশের রিকশা। ‘হাসপাতালে আমার রোগী আছে। ঢাকা মেডিকেল যাইতেসি। ছেড়ে দেন।’ এ কথা বলতে বলতেই একটা কল আসে তৈয়বের ফোনে, ‘ভাই আপনারা কই, আমরা শহীদ মিনার পৌঁছায় গেছি।’ কল রিসিভ করতেই শোনা গেল দলের বাকিদের একজনের কথা। পুলিশ ফোনটি নিয়ে শুনে ফেলে সব। এরপর তৈয়বের কোনো কথা না শুনেই শুরু হলো চড়থাপ্পড়।

তৈয়ব বললেন, ‘সেদিন পুলিশকে কিন্তু আমি মিথ্যা বলিনি। সত্যিই আত্মীয় ভর্তি ছিল ঢাকা মেডিকেলে।’

কোনো রকম দেরি না করেই তৈয়ব ও আকাশকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো। ডিবি কার্যালয়ে নেমে তাঁদের নেওয়া হলো আগে থেকে ঠিক করে রাখা রুমে। সেই ফ্লোরে উঠেই তাঁরা দেখলেন সবাই খুব আতঙ্কে আছে। ছোটাছুটি করছে। ‘ভাবতেছিলাম সবাইরে এক সঙ্গে এনকাউন্টার করবে নাকি একে একে?’ বলছিলেন তৈয়ব। আশপাশের বন্দীরাও ৫ আগস্ট সকাল বা তার আগের দিন থেকে এখানে আছে।

৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে তৈয়ব। ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে তৈয়ব। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু কেউই জানতেন না, কী ঘটবে। ডিবি কার্যালয়ে ঢোকার সময়ই তৈয়বরা সচেতনভাবে প্রমাণ লুকিয়ে ফেলছিলেন। তাঁদের কাছে ছিল স্মার্টফোন ও কপালে বাঁধার জন্য জাতীয় পতাকা। ফোনে ছিল আন্দোলনের ছবি, ভিডিও আর নানা কথোপকথন। যেহেতু তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন ‘আজ মরতেই হবে’, তাই অন্যের জীবনকে নিরাপদ রাখার জন্য চালাচ্ছিলেন আপ্রাণ চেষ্টা।

সিসি ক্যামেরার ঠিক উল্টো পাশে যেখান থেকে দেখা যায় না, সে রকম একটা জায়গা পেয়ে গেলেন। ফোন বন্ধ করে লুকিয়েছিলেন সেখানকার দেয়ালের খসে পড়া প্লাস্টার আর ফাঁকা হয়ে থাকা ভাঙা ইটের মধ্যে। আর বাথরুমের পানি নিষ্কাশনের নেটের মধ্য দিয়ে পতাকাটাকে চিকন ভাঁজ করে ফেলে দিতে হয়েছিল।

‘আসতেছে, মাইরা ফেলাবে এখন’

বন্দীদের মধ্যে তৈয়ব এমন একজনকে পেয়েছিলেন, মার খেতে খেতে যাঁর মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরপর বলছিল, ‘ওই যে আসতেছে। মাইরা ফেলাবে।’ তা ছাড়া, পরিচয় জানার পরিস্থিতিও ছিল না তখন।

তবে আজও তাঁকে মন থেকে সরাতে পারেন না তৈয়ব। ‘কিছুক্ষণ পরপর নিজ মনে হাসছিল আর কাঁদছিল ছেলেটি।’ ছেলেটির কথা ভেবেই কি ফোনের ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তৈয়ব! তিনি বলেই যাচ্ছিলেন, ‘আমি জানি না ছেলেটি সেখানে কত দিন ধরে বন্দী ছিল। পরে তো এ-ও জানতে পারিনি যে সে সুস্থ হয়েছিল কি না।’

ডিবি কার্যালয়ের সেদিনের ছবি ফুটে উঠল তৈয়বের মুখে, ‘অল্প আলোর ওই ঘরে বোঝা যাচ্ছিল না ঠিক কতখানি বেলা।’ ক্ষুধার্ত তৈয়ব মৃত্যুর নিয়তি মেনে নিয়ে নির্ভার হওয়ার পরিহাসে নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘হারুনের ভাতের হোটেল কই? ক্ষুধা লাগসে।’ এর মধ্যেই হঠাৎ গুঞ্জন উঠল, ‘হাসিনা পলাইছে।’

কথাটা তৈয়বরা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। ততক্ষণে ডিবি কার্যালয়ের ১ নম্বর বন্দী বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁকে গিয়ে ফোন নম্বর দিয়ে তৈয়ব বললেন, ‘বের হওয়ার পর বেঁচে থাকলে কল করতে।’

কিছুক্ষণ পরপর বাইরে থেকে স্লোগানের অস্পষ্ট শব্দ আসছিল। তৈয়বরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না মিছিলটি কোন পক্ষের—আন্দোলনকারী নাকি ছাত্রলীগ। পুলিশের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন তৈয়ব। তারপর দেখলেন, কার্যালয়ের কর্মচারীদের একজনের চোখে কান্না, মুখে হাসি। বন্দীরা তখন বুঝলেন, সেটা ছিল বিজয় মিছিলের শব্দ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত