leadT1ad

নেই সুনির্দিষ্ট আইন /ধর্ষণের ভিডিও প্রচারে শাস্তির নজির কম, অনলাইনে বাড়ছে হয়রানির কনটেন্ট

ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি আসলে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে মনে করছেন আইন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫’ এর ধারা ২৫ পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে।

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ১৯: ৩০
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ১২: ৪৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

গত সপ্তাহে কুমিল্লার মুরাদনগরে যৌন নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হন এক নারী। সেই নারীকে বিবস্ত্র করে হয়রানি করা হয় এবং তার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী থানায় গেলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা নেয় পুলিশ।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হলে ভিডিও ধারণে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে ভিডিওটি যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছেন তাঁদের বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনাও নেই। আইনবিদেরা বলছেন, এ ধরনের তৎপরতা রোধে স্পষ্ট আইন না থাকায় ভিডিও ছড়ানোকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন না অনেকেই। ফলে বারবার ঘটছে এই ধরনের ঘটনা।

গত ছয় মাসে ধর্ষণের পর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ৯টি ঘটনা তাদের নজরে এসেছে। এ সব ঘটনার খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেগুলোর মামলা হয়েছে পর্নোগ্রাফি আইনে।

২০১৯ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ভিডিও ধারণ এবং প্রচার করা হয়েছে, এমন ২২টি ঘটনা নজরে এসেছে স্ট্রিমের। গণমাধ্যম এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে কোন কোন ক্ষেত্রে বিচার এগিয়েছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁরা ধর্ষণের ভিডিওগুলো প্রচার করেছে, তাঁদের বিচার হওয়ার নজির কম।

বিচার না হওয়ায় ভিডিও প্রচারের ক্ষেত্রে কেউ তেমন ভয় পায় না। ফলে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের পর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হার দিন দিন বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন আইনবিদ মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই অধ্যাপক স্ট্রিমকে বলেন, গত পাঁচ–ছয় বছরে যে ২২ টি ধর্ষণের ঘটনা অনলাইনে ছড়িয়েছে, সেগুলোর মধ্যে চার–পাঁচটির বিচার হয়েছে। বিচারগুলো আবার যথাযথ আইনি ব্যবস্থা বা বিধিমালা অনুযায়ী হয়নি। ফলে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।

মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ সব মামলার বিচার হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের বাইরে যাঁরা এই ভিডিও ছড়াচ্ছেন তাঁদের কি শাস্তি হবে—এই আইনে তা স্পষ্ট নয়। চলতি বছরে প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা থাকলেও, এর শাস্তির বিধান কমে গেছে।

ভিডিও ছড়ানোর ক্ষেত্রে যারা সহায়তা করছে তাঁদের কোন বিচার হয়নি। ফলে এ ধরনের অপরাধ যাঁরা করেন, তাঁরা বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নেন না। মোবারক মোহাম্মদ, নির্বাহী বোর্ডের সদস্য, আসক

আইনের ফাঁকফোকরে বাড়ছে অপরাধ

২০২০ সালের আগস্টে পাবনার চাটমোহরের মথুরাপুর এলাকায় সিরাজুল ইসলাম শিরু (৫৬) নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, একই এলাকার এক কিশোরীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন সিরাজুল। কিশোরী রাজি না হলে একপর্যায়ে গলায় চাকু ধরে হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়। কৌশলে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে সংরক্ষণ করেন সিরাজুল।

পরে কিশোরীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ করে ছড়ানোর দায়ে সিরাজুলকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন রাজশাহীর আদালত। আদালত সাজাপ্রাপ্তকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও নয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী বোর্ডের সদস্য মোবারক মোহাম্মদ বলেন, ঘটনাটির ভিডিও করেছিলেন সিরাজুল। কিন্তু ছড়ানোর ক্ষেত্রে আরও অনেকের সংশ্লিষ্টতা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ভিডিও ছড়ানোর ক্ষেত্রে যারা সহায়তা করছে তাঁদের কোন বিচার হয়নি। ফলে এ ধরনের অপরাধ যাঁরা করেন, তাঁরা বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নেন না।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গণমাধ্যমে ভুক্তভোগীর নাম, ঠিকানা বা ছবি প্রকাশ নিষিদ্ধ থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসব প্রকাশের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

পর্নোগ্রাফি বনাম ধর্ষণের ভিডিও: আইনি বিভ্রান্তি

পাঁচ বছর আগে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে নবম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। অভিযুক্তরা ধর্ষণের সেই ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে। পরে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং ভিডিও প্রচারের অভিযোগে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা নেয়। আজ পর্যন্ত ওই মামলার কোন সুরাহা হয়নি।

প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ সব মামলার বিচার হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের বাইরে যাঁরা এই ভিডিও ছড়াচ্ছে তাদের শাস্তি কি হবে— এই আইনে তা স্পষ্ট নয়। মাহবুবুর রহমান, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি আসলে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে মনে করছেন আইন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫’ এর ধারা ২৫ পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এটি মূলত স্বেচ্ছায় তৈরি এবং অনেক সময় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রচারিত কনটেন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধর্ষণের ভিডিও এসবের বাইরে। যা মূলত জোরপূর্বক, সম্মতিহীন এবং অপরাধমূলক কাজের দলিল।

আসকের সদস্য মোবারক মোহাম্মদ বলেন, ‘ধর্ষণের ভিডিও কেবল অশ্লীল নয়, এটি ভুক্তভোগীর জন্য ভয়াবহ মানসিক আঘাতের কারণ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত এসব কনটেন্টকে অপরাধের প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা।’

অবশ্য আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। এই নারী অধিকার কর্মী স্ট্রিমকে বলেন, প্রচলিত আইনই সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। তাই নতুন করে আইন নিয়ে এলেও যে খুব একটা লাভ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গণমাধ্যমে ভুক্তভোগীর নাম, ঠিকানা বা ছবি প্রকাশ নিষিদ্ধ থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসব প্রকাশের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।

তিনি আরও বলেন, অনেকে মনে করেন, যে শাস্তির বিধান কম-বেশির সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক নেই। এটা একেবারে ভুল ধারণা। শাস্তির বিধান বাড়িয়ে ও তা কার্যকরের যথাযথ উপায় খুঁজে বের করে বিচার কার্য সম্পন্ন করলেই এসব অপরাধ কমে আসবে।

তাই সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশে ২৫ ধারার পরিবর্তন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের কথা বলেন তিনি।

পর্নোগ্রাফি নয়, প্রয়োজন অন্য আইন

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে ধর্ষণের পর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ৯টি ঘটনা তাদের নজরে এসেছে। এ সব ঘটনার খবর গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেগুলোর মামলা হয়েছে পর্নোগ্রাফি আইনে।

আসকের সদস্য মোবারক মোহাম্মদ বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে ভুক্তভোগীকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলা হয়। এটি একটি অপরাধের ভিডিও, অথচ আমরা সেটিকে ‘পর্নো’ হিসেবে বিবেচনা করে ভুল করছি। এসব ঘটনার বড় অংশ পর্নোগ্রাফি নয়, বরং পরিকল্পিত ব্ল্যাকমেইল, মানহানির উদ্দেশ্যে করা অপরাধ। তাই পর্নোগ্রাফি আইনের বদলে অন্য আইন প্রয়োজন।

তিনি বলেন, সাইবার সুরক্ষা আইনে এ বিষয়ে যথাযথ বিধিমালা থাকলে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সঙ্গে যুক্ত করে আরও বেশি শাস্তি নিশ্চিত করা যেত।

Ad 300x250

বৈষম্য নিরসনে সবাই লড়াই করলেও রাষ্ট্র থেকে বৈষম্য দূর হয়নি: আবু সাঈদের ভাই

তেলঙ্গানায় রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণ, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৯

জোহরান মামদানি যেখানে জন্মান, সেই উগান্ডা কেন ভারতীয়দের তাড়িয়েছিল

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: কোটা আন্দোলন দিয়ে শুরু, সরকার পতনে শেষ

জুলাই সনদ আদায়ে রাজপথে ফেরার হুঁশিয়ারি এনসিপির

সম্পর্কিত