leadT1ad

মাদকাসক্তের জন্য কতটা প্রস্তুত নিরাময় কেন্দ্রগুলো

যেভাবে চলছে মাদক নিরাময় কেন্দ্র

আজ আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা এখন দেড় কোটি। মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮৩ লাখ। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে ৩৮৫টি।

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ২০: ৫২
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ২০: ৫৩
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

সরকারিভাবে দেশে মাদকসেবীদের নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) হিসাবে দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি মানুষ পুরোপুরি মাদকাসক্ত। আর বাকি ৫০ লাখ মাঝেমধ্যে মাদক সেবন করে। এই বাস্তবতায় দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে ৩৮৫ টি। যার বেশিরভাগই স্বল্প ধারণক্ষমতার। মানসের তথ্য অনুসারে, মাদকের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন তরুণরা। দেশের ৮০ শতাংশ মাদকাসক্ত ব্যক্তি কিশোর ও তরুণ। যাঁদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ পুরুষ, আর ১৬ শতাংশ নারী।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বাস্তবতা

১৯৯৮ সালে ঢাকায় প্রথম মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর মাদকের ভয়াবহ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ‘রিহ্যাব’ হিসেবে পরিচিত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে চারটি এবং বেসরকারিভাবে ৩৮১টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠান মাদকাসক্তদের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যের স্বাভাবিক পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও অনেক সেবাপ্রার্থী সেখানে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রেগুলোতে সেবাগ্রহীতাকে পিটিয়ে হত্যার নজিরও আছে।

গত ২১ জুন রাজশাহীতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নির্যাতনে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরে মে মাসে কুমিল্লার একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক যুবকের মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, নিরাময় কেন্দ্রের লোকজনের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ভুক্তভোগীর।

তবে সবার গল্প এক রকম নয়। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার দৃষ্টান্তই বরং বেশি।

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কথা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে প্রতি মাসে একবার করে পরিদর্শন করা হয়। ভর্তি রোগীদের কোনো অভিযোগ থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

মাদকের অন্ধকার থেকে ফিরেছেন যাঁরা

৩২ বছর বয়সি আসলাম (ছদ্মনাম) পেশায় ডেকোরেটর ব্যবসায়ী। ব্যবসা শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন ইয়াবার নেশায়। প্রথমে কেউ বুঝতে না পারলেও এক বছরের মাথায় তার স্ত্রী বুঝতে পারেন আসলামের মাদকাসক্তির বিষয়ে। ২০২৩ সালে পরিবারে সদস্যরা জোর করে আসলামকে পাঠায় বগুড়ার শান্তাহারের একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। পাঁচ মাস সেখানে ছিলেন আসলাম।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ভেতরের পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে আসলাম বলেন, আমি যে নিরাময় কেন্দ্রে ছিলাম সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা ছিল। নিজের কাজ নিজের করতে হতো। স্টাফদের কাজও করে দিতে হতো। তাঁদের ভাতের থালা থেকে বাথরুম পর্যন্ত পরিষ্কার করিয়ে নিতো। কাজে ভুল হলে চলতো মারধর। যখন কেউ নেশা করার জন্য ছটফট করত, তখন মারধর করে গোসল করতে পাঠানো হতো।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফেরত আরেকজন সিরাজ (ছদ্মনাম)। ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আসক্ত হন মাদকে। গাঁজা, মদ, ইয়াবা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সময় যত বাড়তে থাকে, সিরাজের আসক্তিও তত বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে কর্মজীবনে গিয়েও নেশার সঙ্গ ছাড়তে পারেনি সিরাজ।

টানা ১০ বছর মাদকাসক্ত জীবনের পর ২০২১ সালে সিরাজ নেশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়রের পরামর্শে ভর্তি হন উত্তরার একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। টানা ছয় মাস থাকেন সেই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে সিরাজ বলেন, ‘আমি যেখানে ছিলাম সেখানের পরিবেশ অনেক ভালো ছিল। সেখানের খাবার, থাকার জায়গা ও স্টাফদের ব্যবহার–সব কিছুই ভালো ছিল।’

স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কত দিন সময় লেগেছে জানতে চাইলে সিরাজ বলেন, ‘আমার নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রবল ইচ্ছে আর মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চেষ্টায় ৬ মাসের মধ্যেই আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সাথে এমন বেশ কয়েকজন ছিল যারা একাধিকবার রিহ্যাব সেন্টারে ছিল। একজন ছিল যে একে একে ১০ বার রিহ্যাবে এসেছে।’

সাকিব (ছদ্মনাম) ২০১৬ সালে গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন বগুড়া জেলা শহরের একটি কলেজে। থাকার জন্য একটি মেসে ওঠে।

একদিন আড্ডায় বন্ধুদের অনুরোধে গাঁজা সেবন করেন। এরপর দিন যত বাড়তে থাকে সাকিব তত ঝুঁকে পড়ে সব ধরনের নেশার দিকে। একপর্যায়ে পুরোপুরি আসক্ত হয় পড়েন ইয়াবায়। টানা তিন বছর সেবন করেন ইয়াবা।

মাদক গ্রহণের জন্য বিভিন্ন বাহানায় বাড়ি থেকে বড় অংকের টাকা নিতে থাকে সাকিব। এক পর্যায়ে বিক্রি করা শুরু করে বাড়ির আসবাবপত্র। পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারেন সাকিব মাদকাসক্ত। প্রথমে সাকিকবে ঘরবন্দী করে রাখে তার পরিবার। কিছুদিন আটকে রাখার পর সাকিবকে পাঠানো হয় একটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে।

সাকিবের মা জাহানারা জানান, ছয় মাস মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন সাকিব। প্রথম কয়েক মাস নেশা থেকে দূরে থাকলেও আস্তে আস্তে আবার হয়ে পড়েন মাদকাসক্ত।

এরপর আবার এক বছরের জন্য তাকে পাঠানো হয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। এখনও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে রয়েছে সাকিব।

‘ফিরতি রোগী’ নিয়ে যা বলছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ফিরতি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে কেন, তা জানতে কথা হয় বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নতুন দিগন্তের স্বত্বাধিকারী তানভীর আহমেদ সুমনের সঙ্গে।

তিনি বলেন, চিকিৎসা শেষে পরিবারের অবহেলা, সন্দেহ, সামাজিক অবহেলা থেকে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে অনেকেই আবার নেশার জগতে ফেরেন।

তিনি আরও বলেন, কখনো কখনো জোর করে ভর্তি করানো হলে রোগী এটা মেনে নিতে পারেন না। ফলে কাউন্সেলিং শেষ করে বাসায় ফেরার পর জেদ থেকে আবার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন।

রোগীদের শারীরিক নির্যাতন করার প্রসঙ্গে সুমন বলেন, কোথাও কোথাও হয়ত এমন হয় কিন্তু এটা কেন তারা করে আমার জানা নেই।

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

‘ফিরতি রোগী’ নিয়ে গাজীপুরে আহ্ছানিয়া মিশন মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুম্মান্নি জান্নাত বলেন, পূর্ণ মেয়াদ চিকিৎসা সম্পূর্ণ করার পর আমরা প্রতিটি রোগীর পরিবারকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকি। অনেকেই এসব নির্দেশনা মানেন না। নিয়মিত ফলোআপে আসেন না। অনেকে বাসায় ফিরে মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে পুনরায় তার আগের সঙ্গীদের সাথে যোগাযোগ করেন। আবার পরিবারও প্রয়োজনের অধিক টাকা দেওয়ার কারণে অনেকে পুনরায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।

সমাধান কী

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নির্যাতনের অভিযোগের বিষয় নিয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ মোহিত কামালের সাথে।

মোহিত কামাল বলেন, ‘কোনো মাদকাসক্ত রোগীই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে চায় না। সে সব সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ও নেশা করতে চায়। মুক্ত অবস্থা থেকে বন্দী অবস্থায় এলেই তার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। একজন মাদকাসক্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হলে সে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে যায়। কারণ এখানে কোনো প্রকার মাদক গ্রহণের সুযোগ থাকে না। বাইরে ঘোরাফেরা বা আড্ডা দেওয়ার সুযোগ থাকে না। মাদক গ্রহণ করতে না পেরে প্রথম দিকে তার মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা তৈরি হয়। তা ছাড়া তার খাওয়া ঘুম সবকিছুর মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। তার জন্য কাউন্সেলিং করা হয়। প্রথম দিকে এর কোনো কিছুই তার ভালো লাগে না।‘

নিরাময় কেন্দ্র থেকে ‘রোগীরা যেকোনো ভাবে বাইরের পরিবেশে আসতে চায়’ উল্লেখ করে ডা. মোহিত কামাল আরও জানান, এই আসার জন্য যত ধরনের মিথ্যা কথা বলা যায় সে (রোগী) বলতে থাকে। সে এমনভাবে মিথ্যা কথা বলবে যে, মা-বাবাসহ যেকোনো নিকটজন আবেগপ্রবণ হবেন। তার কথাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। সন্তান বা প্রিয়জনকে ভালো করতে হলে সঠিক চিকিৎসাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড় রিহ্যাব থেকে আনা যাবে না।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ফিরতি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহিত কামাল বলেন, রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি রোগীর অনেকেই পূর্ণ বা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর বেশির ভাগ রোগী ফলোআপে আসেন না। চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরার পর অনেকেই পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করে মাদক গ্রহণ করেন। এই মাদক একবার গ্রহন করার পর ধীরে ধীরে সে পুনরায় আসক্ত হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ হতাশা, সংকট, পারিবারিক সন্দেহের কারনেও পুনরায় মাদকাসক্ত হয়ে যায়।

নিরাময় কেন্দ্রগুলোর ভেতরকার বাস্তবতা নিয়ে স্ট্রিম প্রতিবেদক কথা বলেছেন এমন কিছু মানুষের সাথে, যারা নিরাময় কেন্দ্রের সেবা নিয়ে মাদকাসক্তি থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন স্বাভাবিক জীবনে। সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় প্রতিবেদনের আলাপচারিতার অংশে তাঁদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।)

Ad 300x250

সম্পর্কিত