প্রতক্ষ্যদর্শী মায়ের ভাষ্য
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক শারমিন সাথী। এই শিক্ষায়তনে তাঁর ছেলে সূর্য সময় বিশ্বাসও পড়ে। ২১ জুলাইয়ের বিমান বিধ্বস্তের সময় তিনি ও তাঁর ছেলে ক্যাম্পাসের দুই ভবনে ছিলেন। এ সময় ছেলেকে স্কুল থেকে নিতে এসেছিলেন তাঁর স্বামী মুকুল বিশ্বাসও। সেদিন আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে কীভাবে তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন ছেলেকে? স্ট্রিমের জন্য সেই দিনের ঘটনা সবিস্তারে লিখেছেন শারমিন সাথী
শারমিন সাথী
আমাদের ছেলে সূর্য সময় বিশ্বাস। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি ভার্সনে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর একই বিদ্যায়তনের কলেজ শাখায় শিক্ষকতা করি আমি। প্রতিদিন ছেলেকে আমিই স্কুলে নিয়ে আসি। তবে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার আগের দিন (২০ জুলাই) সূর্য স্কুলে যায়নি। আমিই যেতে দিইনি। কারণ, ওর বাবা মুকুল বিশ্বাস এর দুই দিন আগে সিয়েরা লিওন থেকে দেশে আসে। তাই আমি ভেবেছিলাম, ছেলেটা বাবার সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাক।
বিমান বিধ্বস্তের দিন সকালে সূর্যকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি ওর স্কুল আর আমার কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে। তখনো আমরা ভাবতে পারিনি, দুপুরবেলা কী পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর আমার সূর্য কপালের জোরে শুধু বেঁচেই যায়নি, আটকে পড়া বন্ধুদের উদ্ধারে সাহায্যও করেছে। এদিকে আমি ও সূর্যের বাবা আতঙ্ক জড়ানো প্রতিটি মুহূর্ত কীভাবে যে পার করলাম! বারবার মনে হচ্ছিল, আমার ছেলেটা বেঁচে আছে তো!
সোমবার বাসা থেকে বেড়িয়ে রিকশা নিতে নিতে সূর্যকে বললাম, ‘বাবু, আজ তো ড্রাইভার ছুটিতে। আসবে না। কলেজে আমার পরীক্ষার ডিউটি আছে। স্কুলে তুমি ঠিকমতো ক্লাস করো। ছুটির পর তোমার বাবা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।’
এখানে বলা দরকার সূর্যের ক্লাস হয় হায়দার আলী ভবনে। আর আমার কর্মক্ষেত্র হলো একই ক্যাম্পাসের এক নম্বর ভবন। তো জানতাম যে সূর্যের ছুটি হবে একটায়। আর ওর বাবা ওকে বাসায় নিয়ে যাবে।
আমি তখন কলেজের ক্লাস শেষ করে সবে একটা রুমে বসেছি। এর মধ্যে সূর্যের বাবা মুকুলের ফোন। বলল, ‘সূর্যকে তো পাচ্ছি না। ওর স্কুলের এক শিক্ষক জানালেন, ও ডিটেনশনে থাকতে পারে।’ এরপর ওর দুজন শিক্ষককে ফোন দিলাম আমি। পেলাম না। মুকুলকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। একটু দেরি হতেই পারে। তুমি অপেক্ষা করো।’
কথা বলা শেষ করে ফোন রাখার এক মিনিটও হয়নি। এর মধ্যেই বিকট আওয়াজ। কানের পর্দা ছিঁড়ে যায় যায় অবস্থা। আমরা সবাই এক নম্বর ভবন থেকে দ্রুত নেমে পড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, জেনারেটর ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু একজন বলল, বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। আমার সে সময় দিশেহারা অবস্থা। ভাবছি, কোথায় আমার সূর্য?
এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি সূর্যের স্কুল অর্থাৎ হায়দার আলী ভবনের সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুন নিচতলা ছাড়িয়ে তখন দোতলায় উঠেছে। ওপরের দিকে আগুনের লেলিহান শিখা যেন আকাশ ছুঁতে উদ্যত।
দৈত্যরূপী আগুন যেন তখন পুরো ভবনটাকেই খেয়ে ফেলতে চাইছে। চোখের সামনেই এসব দেখছি। আর পাগলের মতো ‘আমার সূর্য, আমার সূর্য’ বলে বিলাপ করছি।
ওদিকে সূর্যের বাবা গেটের সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন করলাম। কীভাবে যে ওই সময় ফোন করেছিলাম, এখন আর তা ভাবতেও পারি না। মুকুলের ফোনে রিং হচ্ছে! ও রিসিভ করতেই বলি, ‘তুমি কোথায়? আমার বাবু কোথায়?’
ফোনের ও প্রান্ত থেকে উত্তেজিত গলায় মুকুল বলল, ‘তুমি ক্যান্টিনের এদিকে আসো।’ উত্তেজনাভরা তাঁর এই কাতর কণ্ঠ মুহূর্তেই আমার মনকে বিদীর্ণ করে দিল।
তাঁর কাছে গিয়ে আমি তো আরও ভয় পেয়ে গেলাম। দেখি, সে আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বেরোচ্ছে না। আমি খুব স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সূর্য কি স্কুল থেকে বের হয়নি? তোমার কী হয়েছে?
মুকুল বলল, ‘আমি বিমানের খুব কাছে ছিলাম। জাস্ট দুই সেকেন্ডের মধ্যে আমি লাফ দিয়ে বাম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বিমান আমার ডান দিকে পড়ে। আমি আবারও উঠে দৌঁড়ে কয়েক পা যেতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি সূর্যের স্কুল থেকে বের হওয়ার পথেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।’ আগের চেয়ে ভারী হয়ে গেল মুকুলের গলা। বলল, ‘জানো, আমি চোখের সামনে সূর্যের আগুনে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য মাথায় নিয়ে বিলাপ করছিলাম।’
মুকুলের কাছে এসব শোনার পর আমি তো আর আমার মধ্যে নেই। তবু মনটাকে যথাসম্ভব শক্ত করে সূর্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
দেখলাম, কেউ কেউ পোড়া দেহ, হাত-পা নিয়ে বের হচ্ছে। কী বিভৎস দৃশ্য! আমি জীবনেও ভুলব না এই স্মৃতি। এই পোড়া শিশুদের মধ্যেই আমরা সূর্যকে খুঁজছিলাম।
ততক্ষণে উদ্ধারকর্মীরা গ্রিল ভেঙে শিশুদের বের করছে। কিন্তু সূর্য কোথাও নেই। নেই মানে নেই। তাহলে কি সূর্য মারা গেল? আমিও কি বেঁচে আছি? তখন এমনই মনে হচ্ছিল আমার।
ফোনের দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার। হঠাৎ একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম সূর্যের কণ্ঠ। ছেলের গলা শুনে প্রথমেই যা মনে হলো, আমি বেঁচে আছি। তবে আমার এই বেঁচে থাকার আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে অনেক শিশুর ঝলসে যাওয়া, পুড়ে মরে যাওয়ার আর্তনাদ।
সূর্যকে বাংলা ভার্সনের বিল্ডিংয়ে উদ্ধার করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাসরুম খুঁজে বেড়াচ্ছি অমি। আমি তাঁকে দেখার আগেই সূর্য আমাকে দেখে ফেলল। ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, তুমি আছো? বাবা কোথায়? আমি তোমাদের জন্য অনেক চিন্তা করেছি। বাবা ঠিক আছে?’
সে সময় আমার চোখে পানি নেই। মনে সূর্যকে ফিরে পাওয়ার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। কারণ, আমার পেছনে পুড়ে যাচ্ছে অনেক মায়ের অনেক সন্তান।
এখন সূর্য কীভাবে বেঁচে গেল, সে কথা বলি। আগেই বলেছি, ২০ জুলাই রোববার সূর্য ক্লাসে না যাওয়ার কারণে হোমওয়ার্ক ছাড়াই পরের দিন ২১ জুলাই ক্লাসে যায়। সেজন্য ওর ক্লাসটিচার ওকে ডিটেনশন ক্লাসে যেতে বলে। যে শিক্ষার্থীরা হোমওয়ার্ক করে না বা ক্লাসে পড়া দিতে পারে না, তাদের ছুটির পরে অতিরিক্ত সময় স্কুলে রেখে পড়া আদায় করে বাসায় পাঠানো হয়। একেই বলা হয় ডিটেনশন ক্লাস।
সূর্যের ক্লাসটিচার সূর্যসহ পাঁচজনকে ওই দিন ডিটেনশন ক্লাসে পাঠানোর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা ওই কর্নারের ক্লাসরুমে যাও। আমি একটু পরে আসছি।’ টিচারের কথামতো সূর্যসহ পাঁচজন যখন একেবারে ভবনের শেষ রুমের আগের রুমে যাচ্ছে, ঠিক ওই সময়ে বিকট আওয়াজ শুনে সূর্য পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ওরই ক্লাসরুমের সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ক্লাসরুম থেকে বেরোতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একজন। এ সময় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে ওরা দ্রুতই কর্নারের সেই ডিটেনশন ক্লাসরুমে আশ্রয় নেয়।
ভাগ্য ভালো, ডিটেনশন রুম পর্যন্ত আগুন পৌঁছোতে পারেনি। রুমের ভেতর আগুনের তাপ তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো ছিল (সূর্যের কথা অনুযায়ী)। আমাদেরকে সূর্য যে বর্ণনা দিয়েছে, সে অনুযায়ী ওই রুমের পরিস্থিতিও ছিল ভয়াবহ। সূর্য বলছিল, ‘মা, মনে হচ্ছিল, শরীর তাপে পুড়ে যাচ্ছে। আমরা পাঁচজন জানালার কাছে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কারণ, রুমের ভেতর কালো ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না, নিতে গেলে মনে হচ্ছিল, ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে, মা।’
পরিস্থিতি একটু ঠিক হলে সূর্য যখন ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল, আতঙ্কিত কয়েকজন ছাত্র ভিড়ের ভেতর থেকে হাত দিয়ে তাঁকে ইশারা করল ডান দিকে যাওয়ার জন্য। এরপর ডান দিকে তাকাতেই সূর্য দেখতে পায়, ওখান দিয়ে গ্রিল কেটে বের হওয়ার একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এ সময় ও এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘আপনারা দাঁড়ান। আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে আসছি।’ পরে সূর্য তাড়াতাড়ি ওর বন্ধুদের ডেকে বাইরে নিয়ে এল। তারপর কার্নিশের ওপরে দাঁড়িয়ে আগে নামার সুযোগ করে দিল বন্ধুদের। এ দুর্ঘটনার পর আমাদের ছেলে সূর্যের একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেখানে দেখা যাচ্ছে সাদা শার্ট পরা সূর্য ওর স্কুলভবনের কার্নিশে দাঁড়ানো। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ভিডিও সেই সময়ে করা হয়েছে যখন সূর্য তাঁর বন্ধুদের নামতে সাহায্য করছিল। তবে ভিডিওটি কে করেছিল, এখনো তা আমরা জানতে পারিনি।
আমাদের ছেলেকে আমরা যে শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি, তার যথার্থ প্রয়োগ ও করে দেখাল। কিন্তু এ দুর্ঘটনায় যেসব মায়ের কোল খালি হলো, তাঁদের কাছে আমরা কী জবাব দেব?
লেখক: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
আমাদের ছেলে সূর্য সময় বিশ্বাস। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি ভার্সনে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর একই বিদ্যায়তনের কলেজ শাখায় শিক্ষকতা করি আমি। প্রতিদিন ছেলেকে আমিই স্কুলে নিয়ে আসি। তবে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার আগের দিন (২০ জুলাই) সূর্য স্কুলে যায়নি। আমিই যেতে দিইনি। কারণ, ওর বাবা মুকুল বিশ্বাস এর দুই দিন আগে সিয়েরা লিওন থেকে দেশে আসে। তাই আমি ভেবেছিলাম, ছেলেটা বাবার সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাক।
বিমান বিধ্বস্তের দিন সকালে সূর্যকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি ওর স্কুল আর আমার কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে। তখনো আমরা ভাবতে পারিনি, দুপুরবেলা কী পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর আমার সূর্য কপালের জোরে শুধু বেঁচেই যায়নি, আটকে পড়া বন্ধুদের উদ্ধারে সাহায্যও করেছে। এদিকে আমি ও সূর্যের বাবা আতঙ্ক জড়ানো প্রতিটি মুহূর্ত কীভাবে যে পার করলাম! বারবার মনে হচ্ছিল, আমার ছেলেটা বেঁচে আছে তো!
সোমবার বাসা থেকে বেড়িয়ে রিকশা নিতে নিতে সূর্যকে বললাম, ‘বাবু, আজ তো ড্রাইভার ছুটিতে। আসবে না। কলেজে আমার পরীক্ষার ডিউটি আছে। স্কুলে তুমি ঠিকমতো ক্লাস করো। ছুটির পর তোমার বাবা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।’
এখানে বলা দরকার সূর্যের ক্লাস হয় হায়দার আলী ভবনে। আর আমার কর্মক্ষেত্র হলো একই ক্যাম্পাসের এক নম্বর ভবন। তো জানতাম যে সূর্যের ছুটি হবে একটায়। আর ওর বাবা ওকে বাসায় নিয়ে যাবে।
আমি তখন কলেজের ক্লাস শেষ করে সবে একটা রুমে বসেছি। এর মধ্যে সূর্যের বাবা মুকুলের ফোন। বলল, ‘সূর্যকে তো পাচ্ছি না। ওর স্কুলের এক শিক্ষক জানালেন, ও ডিটেনশনে থাকতে পারে।’ এরপর ওর দুজন শিক্ষককে ফোন দিলাম আমি। পেলাম না। মুকুলকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। একটু দেরি হতেই পারে। তুমি অপেক্ষা করো।’
কথা বলা শেষ করে ফোন রাখার এক মিনিটও হয়নি। এর মধ্যেই বিকট আওয়াজ। কানের পর্দা ছিঁড়ে যায় যায় অবস্থা। আমরা সবাই এক নম্বর ভবন থেকে দ্রুত নেমে পড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, জেনারেটর ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু একজন বলল, বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। আমার সে সময় দিশেহারা অবস্থা। ভাবছি, কোথায় আমার সূর্য?
এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি সূর্যের স্কুল অর্থাৎ হায়দার আলী ভবনের সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুন নিচতলা ছাড়িয়ে তখন দোতলায় উঠেছে। ওপরের দিকে আগুনের লেলিহান শিখা যেন আকাশ ছুঁতে উদ্যত।
দৈত্যরূপী আগুন যেন তখন পুরো ভবনটাকেই খেয়ে ফেলতে চাইছে। চোখের সামনেই এসব দেখছি। আর পাগলের মতো ‘আমার সূর্য, আমার সূর্য’ বলে বিলাপ করছি।
ওদিকে সূর্যের বাবা গেটের সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন করলাম। কীভাবে যে ওই সময় ফোন করেছিলাম, এখন আর তা ভাবতেও পারি না। মুকুলের ফোনে রিং হচ্ছে! ও রিসিভ করতেই বলি, ‘তুমি কোথায়? আমার বাবু কোথায়?’
ফোনের ও প্রান্ত থেকে উত্তেজিত গলায় মুকুল বলল, ‘তুমি ক্যান্টিনের এদিকে আসো।’ উত্তেজনাভরা তাঁর এই কাতর কণ্ঠ মুহূর্তেই আমার মনকে বিদীর্ণ করে দিল।
তাঁর কাছে গিয়ে আমি তো আরও ভয় পেয়ে গেলাম। দেখি, সে আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বেরোচ্ছে না। আমি খুব স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সূর্য কি স্কুল থেকে বের হয়নি? তোমার কী হয়েছে?
মুকুল বলল, ‘আমি বিমানের খুব কাছে ছিলাম। জাস্ট দুই সেকেন্ডের মধ্যে আমি লাফ দিয়ে বাম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বিমান আমার ডান দিকে পড়ে। আমি আবারও উঠে দৌঁড়ে কয়েক পা যেতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি সূর্যের স্কুল থেকে বের হওয়ার পথেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।’ আগের চেয়ে ভারী হয়ে গেল মুকুলের গলা। বলল, ‘জানো, আমি চোখের সামনে সূর্যের আগুনে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য মাথায় নিয়ে বিলাপ করছিলাম।’
মুকুলের কাছে এসব শোনার পর আমি তো আর আমার মধ্যে নেই। তবু মনটাকে যথাসম্ভব শক্ত করে সূর্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
দেখলাম, কেউ কেউ পোড়া দেহ, হাত-পা নিয়ে বের হচ্ছে। কী বিভৎস দৃশ্য! আমি জীবনেও ভুলব না এই স্মৃতি। এই পোড়া শিশুদের মধ্যেই আমরা সূর্যকে খুঁজছিলাম।
ততক্ষণে উদ্ধারকর্মীরা গ্রিল ভেঙে শিশুদের বের করছে। কিন্তু সূর্য কোথাও নেই। নেই মানে নেই। তাহলে কি সূর্য মারা গেল? আমিও কি বেঁচে আছি? তখন এমনই মনে হচ্ছিল আমার।
ফোনের দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার। হঠাৎ একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম সূর্যের কণ্ঠ। ছেলের গলা শুনে প্রথমেই যা মনে হলো, আমি বেঁচে আছি। তবে আমার এই বেঁচে থাকার আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে অনেক শিশুর ঝলসে যাওয়া, পুড়ে মরে যাওয়ার আর্তনাদ।
সূর্যকে বাংলা ভার্সনের বিল্ডিংয়ে উদ্ধার করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাসরুম খুঁজে বেড়াচ্ছি অমি। আমি তাঁকে দেখার আগেই সূর্য আমাকে দেখে ফেলল। ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, তুমি আছো? বাবা কোথায়? আমি তোমাদের জন্য অনেক চিন্তা করেছি। বাবা ঠিক আছে?’
সে সময় আমার চোখে পানি নেই। মনে সূর্যকে ফিরে পাওয়ার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। কারণ, আমার পেছনে পুড়ে যাচ্ছে অনেক মায়ের অনেক সন্তান।
এখন সূর্য কীভাবে বেঁচে গেল, সে কথা বলি। আগেই বলেছি, ২০ জুলাই রোববার সূর্য ক্লাসে না যাওয়ার কারণে হোমওয়ার্ক ছাড়াই পরের দিন ২১ জুলাই ক্লাসে যায়। সেজন্য ওর ক্লাসটিচার ওকে ডিটেনশন ক্লাসে যেতে বলে। যে শিক্ষার্থীরা হোমওয়ার্ক করে না বা ক্লাসে পড়া দিতে পারে না, তাদের ছুটির পরে অতিরিক্ত সময় স্কুলে রেখে পড়া আদায় করে বাসায় পাঠানো হয়। একেই বলা হয় ডিটেনশন ক্লাস।
সূর্যের ক্লাসটিচার সূর্যসহ পাঁচজনকে ওই দিন ডিটেনশন ক্লাসে পাঠানোর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা ওই কর্নারের ক্লাসরুমে যাও। আমি একটু পরে আসছি।’ টিচারের কথামতো সূর্যসহ পাঁচজন যখন একেবারে ভবনের শেষ রুমের আগের রুমে যাচ্ছে, ঠিক ওই সময়ে বিকট আওয়াজ শুনে সূর্য পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ওরই ক্লাসরুমের সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ক্লাসরুম থেকে বেরোতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একজন। এ সময় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে ওরা দ্রুতই কর্নারের সেই ডিটেনশন ক্লাসরুমে আশ্রয় নেয়।
ভাগ্য ভালো, ডিটেনশন রুম পর্যন্ত আগুন পৌঁছোতে পারেনি। রুমের ভেতর আগুনের তাপ তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো ছিল (সূর্যের কথা অনুযায়ী)। আমাদেরকে সূর্য যে বর্ণনা দিয়েছে, সে অনুযায়ী ওই রুমের পরিস্থিতিও ছিল ভয়াবহ। সূর্য বলছিল, ‘মা, মনে হচ্ছিল, শরীর তাপে পুড়ে যাচ্ছে। আমরা পাঁচজন জানালার কাছে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কারণ, রুমের ভেতর কালো ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না, নিতে গেলে মনে হচ্ছিল, ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে, মা।’
পরিস্থিতি একটু ঠিক হলে সূর্য যখন ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল, আতঙ্কিত কয়েকজন ছাত্র ভিড়ের ভেতর থেকে হাত দিয়ে তাঁকে ইশারা করল ডান দিকে যাওয়ার জন্য। এরপর ডান দিকে তাকাতেই সূর্য দেখতে পায়, ওখান দিয়ে গ্রিল কেটে বের হওয়ার একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এ সময় ও এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘আপনারা দাঁড়ান। আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে আসছি।’ পরে সূর্য তাড়াতাড়ি ওর বন্ধুদের ডেকে বাইরে নিয়ে এল। তারপর কার্নিশের ওপরে দাঁড়িয়ে আগে নামার সুযোগ করে দিল বন্ধুদের। এ দুর্ঘটনার পর আমাদের ছেলে সূর্যের একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেখানে দেখা যাচ্ছে সাদা শার্ট পরা সূর্য ওর স্কুলভবনের কার্নিশে দাঁড়ানো। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ভিডিও সেই সময়ে করা হয়েছে যখন সূর্য তাঁর বন্ধুদের নামতে সাহায্য করছিল। তবে ভিডিওটি কে করেছিল, এখনো তা আমরা জানতে পারিনি।
আমাদের ছেলেকে আমরা যে শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি, তার যথার্থ প্রয়োগ ও করে দেখাল। কিন্তু এ দুর্ঘটনায় যেসব মায়ের কোল খালি হলো, তাঁদের কাছে আমরা কী জবাব দেব?
লেখক: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
রাজধানীতে সামরিক স্থাপনার প্রয়োজন আছে বলে জানিয়েছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। তবে ঢাকার মতো জনবহুল নগরীতে অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া উন্নয়নের মাঝে এই প্রয়োজনকে সামাল দেওয়ার উপায় কী?
৩ দিন আগেআমি তখন ছিলাম ভবন থেকে একটু দূরে। হঠাৎ একটা শব্দ হলো, এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। এ সময় দেখি আগুন ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি তখন কী করব, হিতাহিতজ্ঞান ছিল না আমার। অসহায়ের মতো কাঁদছিলাম। মাকে ফোন করে বললাম, ‘মা, বাচ্চারা মারা যাচ্ছে মা, আমি কী করব।
৫ দিন আগেপশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে ঠিক এভাবেই হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকেরা। লাগাতার সেই আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে সড়কে নামতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
৬ দিন আগেশেখ হাসিনার সমর্থকেরা নিজেদের এ স্থানকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনাই শুধু করেনি, প্রতিপক্ষ দলের কার্যক্রমকে তাদের প্রভাবের ওপর হুমকি হিসেবেও দেখেছেন। এমন মনোভাব আদতে শেখ পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
১০ দিন আগে