পুশ–ইন, পুশ–ব্যাক
সন্দেহের বশে আটক, মারধর, পুশইন—পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকেরা। পুলিশের বিরুদ্ধে বিচারকের ভূমিকা পালন করার অভিযোগ। প্রতিবাদে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
স্ট্রিম প্রতিবেদক
বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশি, অনাগরিক। অতএব সন্দেহের বশে আটক, অত্যাচার, ঘাড়ধাক্কা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে ঠিক এভাবেই হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকেরা। লাগাতার সেই আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে সড়কে নামতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সরব হয়েছে নাগরিক সমাজ এবং প্রতিবাদ করছেন সচেতন সাংবাদিকেরা।
উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, ওড়িশার মতো রাজ্যগুলোতে প্রথমে বাংলাভাষীদের আটক করার ঘটনা সামনে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, চেন্নাই, হরিয়ানা, আসাম— ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক ও আক্রমণ করা হচ্ছে।
মালদার ৪০ জন পরিযায়ী শ্রমিক সম্বলপুরে সেতু নির্মাণের কাজ করার সময় স্থানীয় লোকজন তাঁদের মারধর করে। ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। বাংলা ভাষায় কথা বলাই তাঁদের নিগ্রহের কারণ বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে চারশো ৪৪ বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক করে ওড়িশা পুলিশ। পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখার পর এবং আদালতের হস্তক্ষেপে দুইশো ৭৭ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পুলিশি ধড়পাকড়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের স্থানীয় লোকজন মারধর করে বলেও অভিযোগ উঠেছে। চেন্নাইয়ের থিরুভেল্লুর এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহিংসতার মুখোমুখি হন মুর্শিদাবাদের তিনজন পরিযায়ী শ্রমিক। নির্মাণশ্রমিকের ৯ জনের একটি দলের মধ্যে তিনজনকে আটকে রেখে নিগ্রহ করা হয়।
স্থানীয় লোকজন তাঁদের ওপর চড়াও হলে অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান। যাঁরা পালাতে পারেননি, তাঁদের নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ আছে।
আক্রান্ত শ্রমিকদের একজনের বাবা আসাদউল শেখ স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, গুধিয়ার মোড়ল পাড়ায় তাঁদের বাড়ি। তাঁর দুই ছেলে রুজি-রুটির টানে চেন্নাইয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১৫ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ কাজ থেকে ফিরে ভাত রান্না করছিলেন তাঁর ছেলেরা। এমন সময় স্থানীয় প্রায় ৩৫-৪০ জন লোক এসে তাঁদের ‘তোরা তো বাঙালি, এখানে কী করছিস! বাংলায় কাজ নেই?’ বলে মারধর শুরু করেন।
আক্রান্ত শ্রমিকদের চেন্নাই থেকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে এসে বহরমপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুর্শিদাবাদ থানায় অভিযোগ নিতে পুলিশ অস্বীকার করে বলে জানান আসাদউল শেখ। এরপর আইসি তদন্তের আশ্বাস দেন। লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন আসাদউল শেখ। কিন্তু থানা থেকে অভিযোগ জমা দেওয়ার কোনো প্রতিলিপি পাননি।
আপনি বলছেন আপনি নতুন বাংলার স্বপ্ন দেখেন। অথচ সেই “নতুন বাংলা”য় আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বললে নিষিদ্ধ করে। আশ্চর্যজনকভাবে আপনি দুর্গাপুর ঘুরে যাওয়ার পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। এটা কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল? সামিরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ
রাজস্থানের শিখর জেলায় ইটভাটায় কাজ করতেন কোচবিহারের সাত পরিযায়ী শ্রমিক। অভিযোগ, বাংলাদেশি সন্দেহে কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা ওবাইদুল খন্দেকার ও তাঁর স্ত্রীকে ১০ দিন আটক করে রেখেছিল রাজস্থানের শিখর জেলার পাতন থানার পুলিশ। ওবাইদুল খন্দেকারের স্ত্রী বিউটি খন্দেকার স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, পুলিশ আটক করার পর তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ চায়। তখনই ভোটার কার্ড, আধার কার্ডসহ সব ডকুমেন্ট জমা দেন তাঁরা। কিন্তু তারপরও তাঁদের ১০ দিন আটকে রাখা হয়।
তিনি দাবি করেন, থানায় নয়, তাঁদের রাখা হয় এক ধর্মশালায়। দিনে দুইবেলা সামান্য যে খাবার দেওয়া হতো তাতে পেট ভরত না বলে জানান বিউটি খন্দেকার। খাবার দেওয়া হতো এক মুঠো ভাত, তিনটি রুটি ও ডাল। ১০ দিন পর পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে স্থানীয় থানা সাহেবগঞ্জে অভিযোগ করেন তাঁরা।
পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে পাঞ্জাবে কাজ করতে গিয়েছিল ছয়জন পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দল। সেখানে ছয়দিন কাজ করার পর ২ জুলাই পুলিশ তাঁদের আটক করে। আটক হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে একজন জাকির হোসেন।
তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে স্ট্রিম জানতে পেরেছে, গ্রামবাসীরা মারধর করে ছয় বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এখনো তাঁরা পুলিশের হাতেই আটক রয়েছেন। কেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়, কারণ জানা যায়নি।
আমরা দিল্লিতে কাজ করতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমাদের ধরেছিল পুলিশ। আমরা আধার কার্ড দেখিয়ে বললাম, আমরা বাংলাদেশি নই। কিন্তু আমাদের দিয়ে কী সব লিখিয়ে নিল! তারপর বলল, “তোরা বাংলাদেশি না হলেও, তোদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেব।’’ পুলিশই এ সব বলছিল।’ দানিশ শেখের স্ত্রী, জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো নারী
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক মনে করেন, ২০১৪ সালের পর থেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। ক্রমে ঘটনা সামনে আসতে থাকে। ২০২২ সালে বেঙ্গালুরু থেকে ৪০ অতিদরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি সন্দেহে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ নথিভুক্ত করে আর্টিকেল ফোরটিন। ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসে মুর্শিদাবাদের বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশি বলে আক্রমণ করে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়।
মালদা মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের সুরক্ষা চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন মালদা উত্তরের সংসদ সদস্য ঈশা খান চৌধুরী। ২০২৫ সালে পহেলগাঁও-কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুরের পর সেই আক্রমণ ও পুলিশি ধরপাকড় বেড়েছে বলে দাবি করছেন আসিফ।
আসিফ স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। এটি বন্ধের দাবিতে ২১ এপ্রিল তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এরপর পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চের পক্ষ থেকে দুটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হলে নিয়মিত সাহায্যের আবেদন আসতে থাকে। প্রথমে উত্তরপ্রদেশ ও ওড়িশা রাজ্যে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে আটকের খবর পান তারা।
পরিযায়ী শ্রমিকসংক্রান্ত একটি মামলা শুনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। কারণ, এই ঘটনায় বাংলাদেশি সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিককে দিল্লিতে আটক করার পর দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১০ জুলাই সেই মামলার শুনানি হয় বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে। বিচারপতিরা জানতে চেয়েছিলেন, ওড়িশায় পরিযায়ী শ্রমিক আটকের মামলার সঙ্গে দিল্লি মামলার পার্থক্যটা কোথায়?
এ সময় মামলাকারী আইনজীবী জানান, ওড়িশায় পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু কাউকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়নি। কিন্তু দিল্লি মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে 'পুশ ব্যাক' করা হয়েছে। এই পরিবারে মা-বাবার সঙ্গে আট বছরের শিশুও রয়েছে। এরপরেই কলকাতা হাইকোর্ট এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছেন।
পাশাপাশি দিল্লির পরিযায়ী শ্রমিদের পরিস্থিতি জানতে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্তকে দিল্লির মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে একই সময়ে কেন বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হলো, এটা কি পূর্বপরিকল্পিত, প্রশ্ন তোলে হাইকোর্ট।
জানা যায়, ১৮ জুন বাংলাদেশি সন্দেহে দিল্লিতে বীরভূমের পাইকরের ছয়জন শ্রমিককে আটক করে দিল্লির রোহিনী পুলিশ জেলার কে এন কাটজু থানা। এরপর ওই শ্রমিকেরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু পরিবারের লোক দিল্লি পৌঁছে জানতে পারে, আটক ব্যক্তিদের বিএসএফের হাতে তুলে দিয়ে বলপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের পরিবার শ্রম দপ্তরেও যোগাযোগ করেছেন বলে জানান।
পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে হাজার হাজার বাংলাভাষীকে আটক করা হয়েছে। বিজেপি এটা বাংলাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে।
Prime Minister @narendramodi, you came to Bengal and spoke extensively about infiltration. Let me introduce you to a woman named Sweaty Biwi, an Indian citizen from Birbhum—the land of Rabindranath Tagore.
— Samirul Islam (@SamirulAITC) July 19, 2025
In the video, she shares the painful ordeal she’s going through.
Sweaty… pic.twitter.com/fRKVxkSvAU
এ ছাড়া নিজের এক্স হ্যান্ডেলে সামিরুল ইসলাম বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে লিখেছেন, ‘আমরা এমন প্রধানমন্ত্রী চাই, যিনি আমাদের বিভাজন করবেন না, সুরক্ষা দেবেন।’
নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশে সামিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আপনি বলছেন আপনি নতুন বাংলার স্বপ্ন দেখেন। অথচ সেই “নতুন বাংলা”য় আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বললে নিষিদ্ধ করে। আশ্চর্যজনকভাবে আপনি দুর্গাপুর ঘুরে যাওয়ার পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। এটা কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল?’
Prime Minister @narendramodi, you came to Bengal and spoke extensively about infiltration. Let me introduce you to a woman named Sweaty Biwi, an Indian citizen from Birbhum—the land of Rabindranath Tagore.
— Samirul Islam (@SamirulAITC) July 19, 2025
In the video, she shares the painful ordeal she’s going through.
Sweaty… pic.twitter.com/fRKVxkSvAU
সামিরুল বীরভূমের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, বীরভূমের মুরারই-২ ব্লকের পাইকর এলাকার বাসিন্দা দানিশ শেখকে বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁর স্ত্রী ও বছর সাতেকের পুত্রসন্তানসহ তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। নথি দেখালেও কাজ হয়নি। সামিরুল দাবি করেন, দানিশ ও তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিডিও বার্তায় দানিশের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা দিল্লিতে কাজ করতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমাদের ধরেছিল পুলিশ। আমরা আধার কার্ড দেখিয়ে বললাম, আমরা বাংলাদেশি নই। কিন্তু আমাদের দিয়ে কী সব লিখিয়ে নিল! তারপর বলল, “তোরা বাংলাদেশি না হলেও, তোদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেব।’’ পুলিশই এ সব বলছিল।’
১৬ জুলাই বংলাভাষীদের বাংলাদেশি সন্দেহে বিভিন্ন রাজ্যে আটকের বিরুদ্ধে কলকাতায় পথে নামে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল। পদযাত্রা শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, কেন্দ্র সরকার বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষীদের আটক করার গোপন নির্দেশিকা জারি করেছে। অন্তত এক হাজারজনকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কতজনকে বাংলাদেশে জোর করে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করছি আমরা।’
১৪ জুলাই নিউ দিল্লির বসন্ত কুঞ্জ এলাকায় জয় হিন্দ কলোনিতে প্রতিবাদ করে তৃণমূল। এই কলোনিতে এক শ বাঙালি পরিবার বসবাস করে। তারা মূলত অসংগঠিত খাতে কাজ করে। তৃণমূলের দাবি, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখালেও তাদের বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ২০ বছর ধরে জয় হিন্দ কলোনিতে বাস করছে। তাদের বাড়ির বিদ্যুৎ-সংযোগ, পানির সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাভাষীদের ওপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে পথে নামে বামফ্রন্টও। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীমহলও মুখ খুলেছেন এর বিরুদ্ধে।
পথে নেমেছে বাংলা পক্ষও। বাংলা পক্ষের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বকালে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি বলে অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে এবং অত্যাচার পর্যায়ক্রমে বাড়ছেই। সেসব নিয়ে নরেন্দ্র মোদি মুখ খোলেননি, এগুলো তাঁদের নির্দেশেই হচ্ছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে ভারতে একেবারে কোণঠাসা করে দিতে চান।’
বিজেপি এভাবে মুসলিমদের ঠেলে দিচ্ছে রাজ্যের শাসক দলের দিকে। এরপর তারা হিন্দুদের বলবে যে মুসলিমরা সব তৃণমূলের দিকে চলে গেছে। হিন্দুরা বিজেপির সঙ্গে এসো, না হলে পশ্চিমবঙ্গ মুসলিমদের হাতে চলে যাবে। স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য, সাংবাদিক
দীর্ঘদিন ধরে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে হওয়া অবিচার নিয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য। বাংলাভাষী দেখেই বাংলাদেশি সন্দেহে আটক এবং বাংলাদেশে 'পুশ ব্যাক' করার মাধ্যমে আসলে ঘুরপথে এনআরসি করা হচ্ছে বলে দাবি তাঁর।
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। পুলিশ এখানে বিচারকের ভূমিকা পালন করছে। যাঁদের আটক করা হচ্ছে, তাঁদের আদালতে তোলা হচ্ছে না। এমনকি যাঁদের আটক করে বেশ কিছুদিন ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের কোনো কাগজ বা ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন্ন রাজ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে আবার অত্যাচারিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।’
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাংলাভাষীদের এইভাবে আটক করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু পহেলগাঁও-কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুরের পর তা বেড়েছে বলে দাবি স্নিগ্ধেন্দুর। বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের আটক হওয়ার সংখ্যা বেশি বলে দাবি তাঁর। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড দিয়ে যদি না হয়, তাহলে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ কীভাবে দেবে এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা? তাঁদের কেউ কেউ বাড়ির বা জমির দলিল দেখিয়েছেন। কিন্তু সবার কাছে তো তা নেই। সবার জন্মসনদও নেই।
এসবের মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, ‘বিজেপি এভাবে মুসলিমদের ঠেলে দিচ্ছে রাজ্যের শাসক দলের দিকে। এরপর তারা হিন্দুদের বলবে যে মুসলিমরা সব তৃণমূলের দিকে চলে গেছে। হিন্দুরা বিজেপির সঙ্গে এসো, না হলে পশ্চিমবঙ্গ মুসলিমদের হাতে চলে যাবে।’
ইতিমধ্যে ত্রিপুরায় অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করতে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। পশ্চিম ত্রিপুরা জেলায় পুলিশের ওই টাস্কফোর্সে থাকছেন ১৫ জন সদস্য। অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে তাঁদের ‘ডিপোর্ট’ (দেশ থেকে বিতাড়ন) করার লক্ষ্যেই এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের বেআইনিভাবে আটক করার ঘটনা কার্যত শোরগোল ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সুতরাং ২০২৬ সালের নির্বাচনে 'বাংলাদেশি হটাও' রাজনৈতিক ইস্যু হতে চলেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
প্রশ্ন উঠছে, শুধু ভাষার ভিত্তিতে কি ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা যায়? উল্লেখ্য গত এক বছর অর্থাৎ বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশ মিথ্যা খবর ছড়িয়েছে। ফলে ‘বাংলাদেশ-ভীতি’ ছড়িয়েছে দেশজুড়েই। অপরীকরণের জন্যে ধর্ম পরিচয় ব্যবহার আগেই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সেই তালিকায় পর্যায়ক্রমিক সংযোজন 'বাংলদেশি' ট্যাগ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, মেরুকরণের নতুন আফিম এই তকমা। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুকৌশলে হিন্দু অভিজাতদেরও কাছে টানার চেষ্টা চলছে। বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, এই আঘাত বাঙালি সত্তার ক্ষতি করছে। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের অস্তিত্ব-সংকট এবং ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘ সম্পর্কের অবমাননাই নয়, ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ওপর আক্রমণও বটে।
বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশি, অনাগরিক। অতএব সন্দেহের বশে আটক, অত্যাচার, ঘাড়ধাক্কা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে ঠিক এভাবেই হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকেরা। লাগাতার সেই আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে সড়কে নামতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সরব হয়েছে নাগরিক সমাজ এবং প্রতিবাদ করছেন সচেতন সাংবাদিকেরা।
উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, ওড়িশার মতো রাজ্যগুলোতে প্রথমে বাংলাভাষীদের আটক করার ঘটনা সামনে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, চেন্নাই, হরিয়ানা, আসাম— ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক ও আক্রমণ করা হচ্ছে।
মালদার ৪০ জন পরিযায়ী শ্রমিক সম্বলপুরে সেতু নির্মাণের কাজ করার সময় স্থানীয় লোকজন তাঁদের মারধর করে। ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। বাংলা ভাষায় কথা বলাই তাঁদের নিগ্রহের কারণ বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে চারশো ৪৪ বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক করে ওড়িশা পুলিশ। পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখার পর এবং আদালতের হস্তক্ষেপে দুইশো ৭৭ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পুলিশি ধড়পাকড়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের স্থানীয় লোকজন মারধর করে বলেও অভিযোগ উঠেছে। চেন্নাইয়ের থিরুভেল্লুর এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহিংসতার মুখোমুখি হন মুর্শিদাবাদের তিনজন পরিযায়ী শ্রমিক। নির্মাণশ্রমিকের ৯ জনের একটি দলের মধ্যে তিনজনকে আটকে রেখে নিগ্রহ করা হয়।
স্থানীয় লোকজন তাঁদের ওপর চড়াও হলে অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান। যাঁরা পালাতে পারেননি, তাঁদের নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ আছে।
আক্রান্ত শ্রমিকদের একজনের বাবা আসাদউল শেখ স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, গুধিয়ার মোড়ল পাড়ায় তাঁদের বাড়ি। তাঁর দুই ছেলে রুজি-রুটির টানে চেন্নাইয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১৫ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ কাজ থেকে ফিরে ভাত রান্না করছিলেন তাঁর ছেলেরা। এমন সময় স্থানীয় প্রায় ৩৫-৪০ জন লোক এসে তাঁদের ‘তোরা তো বাঙালি, এখানে কী করছিস! বাংলায় কাজ নেই?’ বলে মারধর শুরু করেন।
আক্রান্ত শ্রমিকদের চেন্নাই থেকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে এসে বহরমপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুর্শিদাবাদ থানায় অভিযোগ নিতে পুলিশ অস্বীকার করে বলে জানান আসাদউল শেখ। এরপর আইসি তদন্তের আশ্বাস দেন। লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন আসাদউল শেখ। কিন্তু থানা থেকে অভিযোগ জমা দেওয়ার কোনো প্রতিলিপি পাননি।
আপনি বলছেন আপনি নতুন বাংলার স্বপ্ন দেখেন। অথচ সেই “নতুন বাংলা”য় আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বললে নিষিদ্ধ করে। আশ্চর্যজনকভাবে আপনি দুর্গাপুর ঘুরে যাওয়ার পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। এটা কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল? সামিরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ
রাজস্থানের শিখর জেলায় ইটভাটায় কাজ করতেন কোচবিহারের সাত পরিযায়ী শ্রমিক। অভিযোগ, বাংলাদেশি সন্দেহে কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা ওবাইদুল খন্দেকার ও তাঁর স্ত্রীকে ১০ দিন আটক করে রেখেছিল রাজস্থানের শিখর জেলার পাতন থানার পুলিশ। ওবাইদুল খন্দেকারের স্ত্রী বিউটি খন্দেকার স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, পুলিশ আটক করার পর তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ চায়। তখনই ভোটার কার্ড, আধার কার্ডসহ সব ডকুমেন্ট জমা দেন তাঁরা। কিন্তু তারপরও তাঁদের ১০ দিন আটকে রাখা হয়।
তিনি দাবি করেন, থানায় নয়, তাঁদের রাখা হয় এক ধর্মশালায়। দিনে দুইবেলা সামান্য যে খাবার দেওয়া হতো তাতে পেট ভরত না বলে জানান বিউটি খন্দেকার। খাবার দেওয়া হতো এক মুঠো ভাত, তিনটি রুটি ও ডাল। ১০ দিন পর পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে স্থানীয় থানা সাহেবগঞ্জে অভিযোগ করেন তাঁরা।
পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে পাঞ্জাবে কাজ করতে গিয়েছিল ছয়জন পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দল। সেখানে ছয়দিন কাজ করার পর ২ জুলাই পুলিশ তাঁদের আটক করে। আটক হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে একজন জাকির হোসেন।
তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে স্ট্রিম জানতে পেরেছে, গ্রামবাসীরা মারধর করে ছয় বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এখনো তাঁরা পুলিশের হাতেই আটক রয়েছেন। কেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়, কারণ জানা যায়নি।
আমরা দিল্লিতে কাজ করতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমাদের ধরেছিল পুলিশ। আমরা আধার কার্ড দেখিয়ে বললাম, আমরা বাংলাদেশি নই। কিন্তু আমাদের দিয়ে কী সব লিখিয়ে নিল! তারপর বলল, “তোরা বাংলাদেশি না হলেও, তোদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেব।’’ পুলিশই এ সব বলছিল।’ দানিশ শেখের স্ত্রী, জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো নারী
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক মনে করেন, ২০১৪ সালের পর থেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। ক্রমে ঘটনা সামনে আসতে থাকে। ২০২২ সালে বেঙ্গালুরু থেকে ৪০ অতিদরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলাদেশি সন্দেহে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ নথিভুক্ত করে আর্টিকেল ফোরটিন। ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসে মুর্শিদাবাদের বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশি বলে আক্রমণ করে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়।
মালদা মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের সুরক্ষা চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন মালদা উত্তরের সংসদ সদস্য ঈশা খান চৌধুরী। ২০২৫ সালে পহেলগাঁও-কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুরের পর সেই আক্রমণ ও পুলিশি ধরপাকড় বেড়েছে বলে দাবি করছেন আসিফ।
আসিফ স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর আক্রমণের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। এটি বন্ধের দাবিতে ২১ এপ্রিল তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এরপর পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চের পক্ষ থেকে দুটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হলে নিয়মিত সাহায্যের আবেদন আসতে থাকে। প্রথমে উত্তরপ্রদেশ ও ওড়িশা রাজ্যে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে আটকের খবর পান তারা।
পরিযায়ী শ্রমিকসংক্রান্ত একটি মামলা শুনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। কারণ, এই ঘটনায় বাংলাদেশি সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিককে দিল্লিতে আটক করার পর দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১০ জুলাই সেই মামলার শুনানি হয় বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে। বিচারপতিরা জানতে চেয়েছিলেন, ওড়িশায় পরিযায়ী শ্রমিক আটকের মামলার সঙ্গে দিল্লি মামলার পার্থক্যটা কোথায়?
এ সময় মামলাকারী আইনজীবী জানান, ওড়িশায় পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু কাউকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়নি। কিন্তু দিল্লি মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে 'পুশ ব্যাক' করা হয়েছে। এই পরিবারে মা-বাবার সঙ্গে আট বছরের শিশুও রয়েছে। এরপরেই কলকাতা হাইকোর্ট এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছেন।
পাশাপাশি দিল্লির পরিযায়ী শ্রমিদের পরিস্থিতি জানতে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্তকে দিল্লির মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে একই সময়ে কেন বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হলো, এটা কি পূর্বপরিকল্পিত, প্রশ্ন তোলে হাইকোর্ট।
জানা যায়, ১৮ জুন বাংলাদেশি সন্দেহে দিল্লিতে বীরভূমের পাইকরের ছয়জন শ্রমিককে আটক করে দিল্লির রোহিনী পুলিশ জেলার কে এন কাটজু থানা। এরপর ওই শ্রমিকেরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু পরিবারের লোক দিল্লি পৌঁছে জানতে পারে, আটক ব্যক্তিদের বিএসএফের হাতে তুলে দিয়ে বলপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের পরিবার শ্রম দপ্তরেও যোগাযোগ করেছেন বলে জানান।
পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে হাজার হাজার বাংলাভাষীকে আটক করা হয়েছে। বিজেপি এটা বাংলাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে।
Prime Minister @narendramodi, you came to Bengal and spoke extensively about infiltration. Let me introduce you to a woman named Sweaty Biwi, an Indian citizen from Birbhum—the land of Rabindranath Tagore.
— Samirul Islam (@SamirulAITC) July 19, 2025
In the video, she shares the painful ordeal she’s going through.
Sweaty… pic.twitter.com/fRKVxkSvAU
এ ছাড়া নিজের এক্স হ্যান্ডেলে সামিরুল ইসলাম বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে লিখেছেন, ‘আমরা এমন প্রধানমন্ত্রী চাই, যিনি আমাদের বিভাজন করবেন না, সুরক্ষা দেবেন।’
নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশে সামিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আপনি বলছেন আপনি নতুন বাংলার স্বপ্ন দেখেন। অথচ সেই “নতুন বাংলা”য় আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বললে নিষিদ্ধ করে। আশ্চর্যজনকভাবে আপনি দুর্গাপুর ঘুরে যাওয়ার পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। এটা কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল?’
Prime Minister @narendramodi, you came to Bengal and spoke extensively about infiltration. Let me introduce you to a woman named Sweaty Biwi, an Indian citizen from Birbhum—the land of Rabindranath Tagore.
— Samirul Islam (@SamirulAITC) July 19, 2025
In the video, she shares the painful ordeal she’s going through.
Sweaty… pic.twitter.com/fRKVxkSvAU
সামিরুল বীরভূমের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, বীরভূমের মুরারই-২ ব্লকের পাইকর এলাকার বাসিন্দা দানিশ শেখকে বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁর স্ত্রী ও বছর সাতেকের পুত্রসন্তানসহ তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। নথি দেখালেও কাজ হয়নি। সামিরুল দাবি করেন, দানিশ ও তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভিডিও বার্তায় দানিশের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা দিল্লিতে কাজ করতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমাদের ধরেছিল পুলিশ। আমরা আধার কার্ড দেখিয়ে বললাম, আমরা বাংলাদেশি নই। কিন্তু আমাদের দিয়ে কী সব লিখিয়ে নিল! তারপর বলল, “তোরা বাংলাদেশি না হলেও, তোদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেব।’’ পুলিশই এ সব বলছিল।’
১৬ জুলাই বংলাভাষীদের বাংলাদেশি সন্দেহে বিভিন্ন রাজ্যে আটকের বিরুদ্ধে কলকাতায় পথে নামে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল। পদযাত্রা শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, কেন্দ্র সরকার বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষীদের আটক করার গোপন নির্দেশিকা জারি করেছে। অন্তত এক হাজারজনকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কতজনকে বাংলাদেশে জোর করে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করছি আমরা।’
১৪ জুলাই নিউ দিল্লির বসন্ত কুঞ্জ এলাকায় জয় হিন্দ কলোনিতে প্রতিবাদ করে তৃণমূল। এই কলোনিতে এক শ বাঙালি পরিবার বসবাস করে। তারা মূলত অসংগঠিত খাতে কাজ করে। তৃণমূলের দাবি, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখালেও তাদের বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ২০ বছর ধরে জয় হিন্দ কলোনিতে বাস করছে। তাদের বাড়ির বিদ্যুৎ-সংযোগ, পানির সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাভাষীদের ওপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে পথে নামে বামফ্রন্টও। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীমহলও মুখ খুলেছেন এর বিরুদ্ধে।
পথে নেমেছে বাংলা পক্ষও। বাংলা পক্ষের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বকালে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি বলে অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে এবং অত্যাচার পর্যায়ক্রমে বাড়ছেই। সেসব নিয়ে নরেন্দ্র মোদি মুখ খোলেননি, এগুলো তাঁদের নির্দেশেই হচ্ছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে ভারতে একেবারে কোণঠাসা করে দিতে চান।’
বিজেপি এভাবে মুসলিমদের ঠেলে দিচ্ছে রাজ্যের শাসক দলের দিকে। এরপর তারা হিন্দুদের বলবে যে মুসলিমরা সব তৃণমূলের দিকে চলে গেছে। হিন্দুরা বিজেপির সঙ্গে এসো, না হলে পশ্চিমবঙ্গ মুসলিমদের হাতে চলে যাবে। স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য, সাংবাদিক
দীর্ঘদিন ধরে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে হওয়া অবিচার নিয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য। বাংলাভাষী দেখেই বাংলাদেশি সন্দেহে আটক এবং বাংলাদেশে 'পুশ ব্যাক' করার মাধ্যমে আসলে ঘুরপথে এনআরসি করা হচ্ছে বলে দাবি তাঁর।
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। পুলিশ এখানে বিচারকের ভূমিকা পালন করছে। যাঁদের আটক করা হচ্ছে, তাঁদের আদালতে তোলা হচ্ছে না। এমনকি যাঁদের আটক করে বেশ কিছুদিন ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের কোনো কাগজ বা ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন্ন রাজ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে আবার অত্যাচারিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।’
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাংলাভাষীদের এইভাবে আটক করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু পহেলগাঁও-কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুরের পর তা বেড়েছে বলে দাবি স্নিগ্ধেন্দুর। বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের আটক হওয়ার সংখ্যা বেশি বলে দাবি তাঁর। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড দিয়ে যদি না হয়, তাহলে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ কীভাবে দেবে এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা? তাঁদের কেউ কেউ বাড়ির বা জমির দলিল দেখিয়েছেন। কিন্তু সবার কাছে তো তা নেই। সবার জন্মসনদও নেই।
এসবের মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, ‘বিজেপি এভাবে মুসলিমদের ঠেলে দিচ্ছে রাজ্যের শাসক দলের দিকে। এরপর তারা হিন্দুদের বলবে যে মুসলিমরা সব তৃণমূলের দিকে চলে গেছে। হিন্দুরা বিজেপির সঙ্গে এসো, না হলে পশ্চিমবঙ্গ মুসলিমদের হাতে চলে যাবে।’
ইতিমধ্যে ত্রিপুরায় অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করতে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। পশ্চিম ত্রিপুরা জেলায় পুলিশের ওই টাস্কফোর্সে থাকছেন ১৫ জন সদস্য। অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে তাঁদের ‘ডিপোর্ট’ (দেশ থেকে বিতাড়ন) করার লক্ষ্যেই এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের বেআইনিভাবে আটক করার ঘটনা কার্যত শোরগোল ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। বছর ঘুরলেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সুতরাং ২০২৬ সালের নির্বাচনে 'বাংলাদেশি হটাও' রাজনৈতিক ইস্যু হতে চলেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
প্রশ্ন উঠছে, শুধু ভাষার ভিত্তিতে কি ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা যায়? উল্লেখ্য গত এক বছর অর্থাৎ বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশ মিথ্যা খবর ছড়িয়েছে। ফলে ‘বাংলাদেশ-ভীতি’ ছড়িয়েছে দেশজুড়েই। অপরীকরণের জন্যে ধর্ম পরিচয় ব্যবহার আগেই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সেই তালিকায় পর্যায়ক্রমিক সংযোজন 'বাংলদেশি' ট্যাগ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, মেরুকরণের নতুন আফিম এই তকমা। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুকৌশলে হিন্দু অভিজাতদেরও কাছে টানার চেষ্টা চলছে। বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, এই আঘাত বাঙালি সত্তার ক্ষতি করছে। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের অস্তিত্ব-সংকট এবং ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘ সম্পর্কের অবমাননাই নয়, ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ওপর আক্রমণও বটে।
শেখ হাসিনার সমর্থকেরা নিজেদের এ স্থানকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনাই শুধু করেনি, প্রতিপক্ষ দলের কার্যক্রমকে তাদের প্রভাবের ওপর হুমকি হিসেবেও দেখেছেন। এমন মনোভাব আদতে শেখ পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
৪ দিন আগেবন্য প্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে বছরের জুন থেকে আগস্ট—তিন মাস সুন্দরবনে জেলে, বাওয়ালীসহ পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও থামছে না হরিণশিকারিদের তৎপরতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণশিকারি চক্র।
৬ দিন আগেআওয়ামী লীগের শাসনামলে গোপন বন্দিশালায় দায়িত্বরতদের কেউ কেউ বন্দীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বন্দীদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার চালানোর নির্দেশ দিতেন, বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই তা পুরোপুরি পালন করতেন না।
৮ দিন আগেঢাকার স্বাধীন গণমাধ্যম দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনুসন্ধানটির প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ স্ট্রিমের হাতে এসেছে।
১০ দিন আগে