leadT1ad

ভোলাগঞ্জ বাংকারে চোখ অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের, তিনজনের জেল

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৫, ১৭: ২৬

সিলেট সীমান্তে প্রাকৃতিক আর খনিজ সম্পদে ভরপুর উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। এর যে সব স্থানে পাথর ‘কোয়ারি’ ছিল, তার বেশিরভাগই বৈধ-অবৈধভাবে তুলে ফেলা হয়েছে। কেবল বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘বাংকার’ ভোলাগঞ্জে পাথর পাওয়া যাচ্ছে। এবার সেখানেই চোখ পড়েছে পাথর উত্তোলনকারীচক্রের। অবৈধভাবে পাথর তুলে বিক্রি করছে চক্রের সদস্যরা। 

ভোলাগঞ্জ বাংকার থেকে পাথর উত্তোলন ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে দুই বছর করে কারাদণ্ডে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া আড়াই লাখ ঘনফুট বালু ও পেলোডার জব্দ; একই সঙ্গে পাথরবাহী ৫০টি নৌযান ধ্বংস করা হয়েছে। শনিবার (১০ মে) বিকেলের দিকে পরিচালিত এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন নাহার।

অভিযানে দণ্ডিত তিন শ্রমিক হলেন আজিজুল, আলাউদ্দিন ও শফিকুল ইসলাম। এ সময় তেলিখাল এলাকা থেকে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ঘনফুট বালু ও একটি পেলোডার জব্দ করা হয়। এছাড়া কাগজপত্র ঠিক না থাকায় একটি ট্রাককে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ এলাকাটি দেশের অন্যতম বৃহৎ পাথর কোয়ারিগুলো অবস্থিত। নদীভিত্তিক পাথর উত্তোলন ব্যবস্থা সেখানে দীর্ঘদিন চালু ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটে টিলা, নদী, এমনকি পর্যটনস্থল থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বেড়েছে। এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা ভূ–প্রকৃতিকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

পাথর উত্তোলন ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর মাঝামাঝি অভ্যুত্থানের পর সিলেটে বন্ধ থাকা কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে এর কিছুদিন পর পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে আবার বন্ধও করে দেয় প্রশাসন। তবে কোয়ারিগুলাতে আগেই খনন হওয়ায় সেখানে আর পাথর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ের বাংকার ভোলাগঞ্জে চোখ পড়েছে পাথর উত্তোলনচক্রের। সেখান বিভিন্ন খনন যন্ত্রের সাহায্যে অবৈধভাবে পাথর তোলার চেষ্টা করছে তারা।

zero point

কোয়ারি কী?

কোয়ারি মানে পাথর সমৃদ্ধ এলাকা। অধিকাংশ জায়গায়ই উন্মুক্ত খননের মাধ্যমে এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের পাথর, শিলা, বালি ও নুড়ি, স্লেট উত্তোলন করা হয়। অনেক সময় বিশেষ (বাথ স্টোন) পাথর উত্তোলনের জন্য ভূগর্ভস্থ খননও করা হয়। উন্মুক্ত খননে যেমন শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে, প্রায়স মাটি ধসে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় শ্রমিকের; একইভাবে পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব তৈরি করে। পরিত্যক্ত হওয়ার পর অনেক খনি পানিতে ভরে যায়, জমির আর কোনো ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। ভূমিকম্পে ওই এলাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

হাজার বছর ধরে খনিতে কেবল হাতিয়ার ব্যবহার করা হতো, তবে আঠারো শতকে উন্নত বিশ্বে খননের বিকল্প হিসেবে বোমা বিস্ফোরণ ব্যবহার করা হয়। তবে এখনো সিলেটের কোয়ারিগুলো এখনো বেলচা, কোদাল, এক্সকাভেটর (ভেকু), ড্রেসার দিয়ে খনন করা হচ্ছে।

বাংকার কী?

স্থানীয় বাসিন্দারা ‘বাংকার’ বলতে নদীর তলদেশে খনন করে তৈরি গভীর গর্ত বা উত্তোলনকেন্দ্রকে বুঝেন। এসব স্থান থেকে পাথরসহ মূল্যবান খনিজপদার্থ উত্তোলন করা হয়। মূলত এগুলো সরকার নির্ধারিত কোয়ারি এলাকার বাইরে অবস্থান করে ও এই সুযোগে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হয়। এসব ‘বাংকার’ থেকে দিনরাত পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, পরিবেশে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলা এসব বাংকারেই বেশি পরিমাণে অপরিকল্পিত উত্তোলন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ দেশের অন্যতম বৃহৎ কোয়ারি এলাকা। নদীভিত্তিক পাথর উত্তোলন ব্যবস্থা সেখানে দীর্ঘদিন চালু ছিল। তবে পরিবেশের কথা চিন্তা করে সরকার সিলেটের কোয়ারীগুলো থেকে পাথর উত্তোল বন্ধ করে দেয়। তবে বেশ কিছু বছর ধরে এখানে একটি চক্র নিয়মিতভাবে নীতিমালার বাইরে গিয়ে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করে আসছে। এতে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

শনিবারের অভিযানে সহযোগিতা করেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান, সহকারী পরিদর্শক (এসআই) আসিব ইকবাল, উপজেলা প্রশাসনের সিএ মিজানুল কবির ও পুলিশের একটি দল। অভিযান সম্পর্কে কোম্পানীগঞ্জ ইউএনও আজিজুননাহার বলেন, ‘অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন রোধে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পরিবেশ ও সরকারি সম্পদ রক্ষায় এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

থানায় মামলা

অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের দায়ে ইতোমধ্যে কোম্পানিগঞ্জ থানায় ১২টি মামলা হয়েছে। তবে এসব রোধে প্রতিটা সংস্থাকে এখানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে মনে করেন থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছি। জেল-জরিমানা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের পুলিশ সদস্য বারংবার আহত হচ্ছেন, হামলার শিকার হচ্ছেন। আমরা এখানে এলাকাবাসীর শত্রুতে পরিণত হয়ে গেছি এই কারণে।’ এই এলাকার জনপ্রতিনিধি সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকেন এই বেআইনি তৎপরতা রুখে দাঁড়ানো সম্ভব বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, কোম্পানিগঞ্জ অঞ্চলজুড়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে, তারা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিতভাবে পাথর উত্তোলন করছে। কোম্পানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আহমদ আলী বলেন, ‘প্রতি মাসেই অভিযান হয়, কিন্তু কয়েকদিন পরই আবার আগের মতো চলতে থাকে কাজ। যারা ধরা পড়ে, তারা শুধু দরিদ্র শ্রমিক, বড় রাঘব বোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।’

পরিবেশকর্মীদের মতে, যেভাবে নদীর তলদেশ কাটা হচ্ছে, তাতে ভাটির দিকে ভাঙন বাড়ছে। নদীতে পানির প্রবাহ কমে গিয়ে কৃষিকাজও ব্যহত হচ্ছে। এই পাথর উত্তোলন বন্ধে শুধু অভিযান নয়, দীর্ঘমেয়াদে সমাধানের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান, স্থানীয় সচেতনতা বৃদ্ধি ও বড় চক্রগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট বিভাগীয় সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। 

সুজন নেতা ফারুক মাহমুদ বলেন, ‘সিলেট থেকে যে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বা অতীতে হয়েছে, সেটি দিয়ে দেশের মাত্র এক শতাংশ পাথরের চাহিদা মিটানো সম্ভব। তবে সেটি করতে গিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে সিলেটের পরিবশেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এখনই সময় এদের জোড়লোভাবে রুখে দাঁড়াতে বে। নয়তো ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত