leadT1ad

বরাদ্দ থাকলেও জুলাইয়ে ১২ মন্ত্রণালয়ের খরচ শূন্য, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, বড় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কার্যক্রমের বাস্তবায়নে খুবই ধীরগতি। এটি শুধু অর্থের অভাবের কারণে নয় বরং প্রকল্প পরিচালনা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি, ঠিকাদারদের নিয়োগের বিলম্ব, প্রকল্প পরিচালকের বদলি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রকল্পগুলো থেমে থাকে।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, উন্নয়ন ব্যয় আগের বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের তুলনায় অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের শুরুতেই ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। গত জুলাইয়ে দেশের অন্তত ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কোনো প্রকল্প কর্মকর্তাই বরাদ্দের একটি টাকাও খরচ করতে পারেননি। মাসজুড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা খরচ না হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৩০টি প্রকল্পে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আইএমইডি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাইয়ে মোট ১ হাজার ১৯৮টি প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬৪৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকার মাত্র ০.৬৯ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর এটি সবচেয়ে দুর্বল সূচনা। সেই অর্থবছরের জুলাইয়ে এডিপির মাত্র ০.৫৭ শতাংশ খরচ হয়েছিল।

আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, উন্নয়ন ব্যয় আগের বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের তুলনায় অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ৩ হাজার ৪৫৯ কোটি, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল।

জুলাইয়ে ১২টি মন্ত্রণালয়ের শূন্য খরচ

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কোনো প্রকল্প কর্মকর্তাই এডিপি থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতে পারেনি। আইএমইডি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দুর্বল সূচনা দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বরাদ্দের টাকা খরচ করতে না পারা ওই ১২ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রয়েছে—পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইএমইডি নিজেই, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংসদ বিষয়ক সচিবালয়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে ৫৯টি প্রকল্পের জন্য ৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জুলাইয়ে কোনো টাকা খরচ হয়নি। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ১৪টি প্রকল্পে মোট ৪ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কোনো খরচ হয়নি। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ছয়টি প্রকল্পে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কার্যক্রম শূন্য। এভাবে ১২টি মন্ত্রণালয় পুরো মাসজুড়ে কোনো অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাইয়ে দেশের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ০.৬৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট ১ হাজার ১৯৮টি প্রকল্পে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও জুলাইয়ে মাত্র ১ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কম, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সূচনা নির্দেশ করে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, ‘এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, বড় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কার্যক্রমের বাস্তবায়নে খুবই ধীরগতি। এটি শুধু অর্থের অভাবের কারণে নয় বরং প্রকল্প পরিচালনা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি, ঠিকাদারদের নিয়োগের বিলম্ব, প্রকল্প পরিচালকের বদলি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রকল্পগুলো থেমে থাকে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ রোববার একনেকের সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাইয়ে ১ শতাংশের কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। চলতি বছরের বাকি সময়ে প্রকল্পগুলো দ্রুত এগিয়ে নেওয়া জরুরি।’

নামমাত্র খরচের ১৩টি মন্ত্রণালয়, কিছু মন্ত্রণালয় এগিয়ে বাস্তবায়নে

চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম প্রায় শূন্য। তাদের বরাদ্দের ০.১০ শতাংশেরও কম খরচ হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং পরিকল্পনা বিভাগ (উন্নয়ন বরাদ্দ)। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মন্ত্রণালয়গুলোতে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে, যা দেশের এডিপি বাস্তবায়নের মোট গতিকে প্রভাবিত করছে।

তবে কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তুলনামূলকভাবে কার্যক্রমে এগিয়ে রয়েছে। জুলাইয়ে সর্বোচ্চ বরাদ্দের অর্থ খরচ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তারা মোট বরাদ্দের ১১.৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে, যা ২৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সমতুল্য। বাস্তবায়নের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, যেখানে ৭.০৫ শতাংশ খরচ হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, যেখানে ৩.৫৬ শতাংশ বরাদ্দ খরচ হয়েছে।

চতুর্থ অবস্থানে থাকা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তাদের ১৯৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বরাদ্দের মধ্যে ৭ কোটি টাকা খরচ করেছে, যা বরাদ্দের মাত্র ৩.৫১ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে থাকা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা ৪.৪৬ শতাংশ।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি ও বাধা

অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে এডিপি বাস্তবায়নের সমস্যা শুধু অর্থের অভাবে নয়, বরং দুর্বল পরিকল্পনা ও দক্ষ আমলার ঘাটতির কারণে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও প্রকল্প থমকে থাকে। নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণে আমলারা প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার চাপ অনুভব করছেন না। এর গুরুতর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান, রাজস্ব ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে।’

শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, “প্রকল্প অনুমোদনের আগে বাস্তবায়নযোগ্যতা কঠোরভাবে পরীক্ষা করা উচিত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নকে রাজনৈতিকভাবে জিম্মি করা উচিত নয়।”

প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, অনেক প্রকল্প পরিচালক পদ ছেড়ে দিয়েছেন। নতুনভাবে নিয়োগের কাজও সময়সাপেক্ষ। কিছু ঠিকাদার বিশেষ করে যাদের সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের সম্পর্ক ছিল তারা অনেকেই মধ্যপথে প্রকল্প ছেড়ে দিয়েছেন।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একনেক সভায় বলেন, ‘এটা ভালো লক্ষণ নয়। এ বছর কাজ দ্রুত এগোনো উচিত। গত বছরের অজুহাত এখন আর চলবে না। ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাড়ানোর জন্য বিশেষ নজরদারি চলছে। তবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থাকায় জানুয়ারি থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি আবারও শ্লথ হয়ে যেতে পারে।’

উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন সকল মন্ত্রণালয়কে প্রকল্পগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে এবং কোনো অজুহাত দেখানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিষয়:

অর্থনীতি
Ad 300x250

সম্পর্কিত