leadT1ad

আ.লীগ ঘনিষ্ঠ কামাল জামান মোল্লার বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া ও হারানোর নেপথ্যে

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০: ০৪
কামাল জামান মোল্লাকে নিয়ে আলোচনার অন্যতম কারণ তাঁর মালিকানাধীন গুলশানের ভাসাবি ফ্যাশন। ছবি: স্ট্রিম

মাদারীপুর-১ আসনে প্রার্থী হিসেবে আলোচিত ব্যবসায়ী কামাল জামান মোল্লাকে গত ৩ নভেম্বর মনোনয়ন দেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তবে একদিন পরই এই মনোনয়ন স্থগিত করে দলটি। এরপর ‘কেঁচো খুড়তে সাপ’ বের হওয়ার মতো সামনে এসেছে কামাল জামানের নানা কেচ্ছা।

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সখ্য থেকে শুরু করে ওই সময়ে পুলিশের ‘দুর্নীতিবাজ’ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক, একাধিক সরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া– কী করেননি তিনি! এর মধ্যে এক বক্তব্যে তাঁর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

ওই বক্তব্যে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘তারেক রহমান জিন্দাবাদ, ম্যাডাম খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান শহীদ হোক, জয় বাংলা।’ এটা বলে তিনি জিহ্বায় কামড় দেন।

কামাল জামান মোল্লাকে নিয়ে আলোচনার অন্যতম কারণ তাঁর মালিকানাধীন গুলশানের ভাসাবি ফ্যাশন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এই ফ্যাশন হাউস থেকে রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ, অভিনয় শিল্পী ও ব্যবসায়ী পরিবারগুলো কেনাকাটা করতো। প্রতিষ্ঠানটির পোশাক ও জুয়েলারির প্রচারে থাকতেন আলোচিত মডেলরা। প্রচারে বিদেশ থেকেও আনা হতো মডেলদের। ফলে অল্প সময়েই বিত্তবানদের পছন্দের তালিকায় চলে আসে ফ্যাশন হাউসটি। এখানে পুরুষ ও নারীদের লাখ টাকার বেশি দামের পোশাক বিক্রি হতো হরদম। এ ছাড়া দুবাই থেকে আনা আধুনিক নকশার স্বর্ণালংকার বিক্রি হতো ভাসাবি জুয়েলার্সে।

অথচ এই ভাসাবি ফ্যাশন ছিল ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান। ভাসাবির পাশাপাশি কামাল জামানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের ঋণ খেলাপি। সবমিলিয়ে তাঁর ব্যাংক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। গত সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে এসব ঋণ পান তিনি। তবে শোধ করেননি।

যেভাবে ঋণ পান

সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন ও সাবেক নেতারা সরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদগুলোয় পরিচালক নিয়োগ পেতে শুরু করেন। ওই সময় আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে বসানো হয় বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে পদত্যাগের আগে ব্যাংকটিকে কার্যত ধ্বংস করেন বাচ্চু। ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এত বেশিতে ঠেকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এটি চলছে লোকসানে।

ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে বেসিক ব্যাংকে হিসাব খুলে ঋণ আবেদন করেন কামাল জামান মোল্লা। এরপর বিভিন্ন সময় ভাসাবি ফ্যাশনের নামে ৮৭ কোটি, ভাসাবি গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান তাহমিনা ডেনিম লিমিটেডের নামে ৫২ কোটি, তাহমিনা নিটওয়্যার লিমিটেডের নামে ৬০ কোটি, ওয়াটার হ্যাভেন করপোরেশনের নামে ৬৭ কোটি এবং ট্রেড হাউজের নামে ৫০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। ব্যাংকটিতে এই গ্রুপের ঋণের স্থিতি এখন ৩৪৪ কোটি টাকা। বিপুল এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ২০১৪ সালে খেলাপির খাতায় ওঠে ভাসাবি গ্রুপের নাম।

এরপর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় ভাসাবি গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমডিসহ বেসিক ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই দিনে তিনটি মামলা করে দুদক। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি ওই মামলায় গ্রেপ্তারও হন। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই তারা জামিনে মুক্তি পান। পরবর্তীতে ঋণ পুনঃতফসিল করতে গ্রুপটি ২০২৩ সালের জুনে ৪৮ লাখ টাকা ও জুলাইয়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেয়।

এর বাইরে ভাসাবি গ্রুপের অগ্রণী ব্যাংকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা এবং রূপালী প্রায় দেড় শ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এখানেও ঋণের কিস্তি দেয়নি গ্রুপটি। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষপর্যন্ত তা হয়নি।

বেসিক ও অগ্রণী ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা জানান, তখনকার সরকারের (আওয়ামী লীগ) শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপে কামাল জামান মোল্লাকে ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ পেতে তিনি আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি ‘মডেলদের’ ব্যবহার করেন। একইভাবে ৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতা পরিচয়ে সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এভাবে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

ভাসাবি ফ্যাশন যেভাবে আলোচিত

তিন সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করলেও ব্যবসা বন্ধ হয়নি কামাল জামান মোল্লার। বরং উচ্চমূল্যের পোশাক ও স্বর্ণালঙ্কারের কারণে বিত্তবানদের অন্যতম পছন্দ হয়ে ছিল ফ্যাশন হাউসটি। উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি ভিড় থাকতো মডেল ও অভিনয় শিল্পীদেরও।

ঢাকার অভিজাত পোশাক ও স্বর্ণের বাজার সম্পর্কে খবর রাখেন এমন এক ব্যবসায়ী স্ট্রিমকে জানান, বেশির ভাগ মডেলদের উপহার এই হাউস থেকে যায়। এ জন্য মডেলদের সঙ্গে কামাল জামান মোল্লার সুসম্পর্ক রয়েছে। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের সঙ্গেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ছিল ভাসাবি ফ্যাশনকে কেন্দ্র করে। বেনজীরকে ফুলকে দেওয়ার ছবিও আছে তাঁর।

তিনি আরও জানান, বিত্তবান ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও পুলিশ কর্তাদের পরিবারগুলোর যাতায়াত থাকায় ঋণখেলাপি হলেও ফ্যাশন হাউসটির ব্যবসা বন্ধ হয়নি। বরং আওয়ামী লীগ আমলে ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিলেন কামাল জামান মোল্লা। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠরা গা-ঢাকা দেওয়ায় ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। যদিও অতি দ্রুত বিএনপি ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেন কামাল জামান মোল্লা। এমনকি বিএনপির মনোনয়নও বাগিয়ে নেন। যদিও তা ধরে রাখতে পারেননি। এখন এলাকায় আন্দোলন করে তা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

গুলশানে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান থেকে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শিবচর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কামাল জামান মোল্লা। এজন্য জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসহ ব্যানার-ফেস্টুনও স্থাপন করেন। গুলশান-২ গোলচত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে ছিল এমন ফেস্টুন।

শেষ পর্যন্ত গত ৩ নভেম্বর বিএনপি যে ২৩৭টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে তার মধ্যে মাদারীপুর-১ থেকে মনোনয়ন পান কামাল জামান মোল্লা। তবে রাতেই ওই আসনে মনোনয়নবঞ্চিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা প্রতিবাদে মাঠে নামেন। তারা ঢাকা–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে গাছের গুঁড়ি ফেলে আগুন জ্বালান এবং বিক্ষোভ মিছিল করেন।

পরদিন ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে তাঁর মনোনয়ন স্থগিত করে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘অনিবার্য কারণে মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসন ও দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম স্থগিত রাখা হলো।’

এই স্থগিতাদেশ তুলতে আবার রাস্তায় নেমেছেন কামাল জামান মোল্লার অনুসারীরা। গত রোববার ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তার কর্মী-সমর্থকরা। এ সময় প্রায় আধ ঘণ্টা এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল বন্ধ থাকে।

আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের উচ্চপর্যায়ে ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও এমন একজনকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে স্ট্রিম। তবে তাঁদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি কামাল জামান মোল্লার সঙ্গে। তিনিও কল ধরেননি।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত