leadT1ad

ভোটের আগে ভোট: অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্নিপরীক্ষা আসন্ন ডাকসু নির্বাচন

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ৫৯
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ১২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। স্ট্রিম ছবি

অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি সমস্যার দায় গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে পার পেতে চেয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু) নির্বাচনে কোন সমস্যা হলে তার দায় এড়াতে পারবে না।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচন হবে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে ডাকসু নির্বাচনেই তা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

এটা ঠিক যে, ডাকসু নির্বাচনকে জাতীয় রাজনীতির জন্য বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখানো অতিরঞ্জন। তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, ডাকসু থেকেই বাংলাদেশের বহু বড় নেতা বেরিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে ডাকসু ও এর নেতারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। ডাকসু ১৯৯০-র দশকে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতনেও ভূমিকা রেখেছিল।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এরশাদ পতনের পর গণতন্ত্র ফিরলেও ডাকসু গুরুত্ব হারায়। পরবর্তী ত্রিশ বছরে কোনো ডাকসু নির্বাচন হয়নি। এর মূল দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপানো হয়। কারণ তারা নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

ভোটের ফলাফলে গড়মিল এবং অনিয়মের অভিযোগে একের পর এক ডাকসু নির্বাচন বয়কট করা হয়। এই ব্যর্থতা অব্যাহত থাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় আমলেই।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত সেখান থেকেই আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা দুর্বল হতে শুরু করে। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রাজনীতিকে অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন রূপ দেয়।

ভোটের ফলাফলে গড়মিল এবং অনিয়মের অভিযোগে একের পর এক ডাকসু নির্বাচন বয়কট করা হয়। এই ব্যর্থতা অব্যাহত থাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় আমলেই।

নতুন ইতিহাস

সেবার ডাকসু নির্বাচনের আগে নুরুল হক নূর জাতীয় মনোযোগে কোনো জায়গা করে নিতে পারেননি। কোনো প্যানেল ছাড়াই নুর ছিলেন পুরোপুরি স্বতন্ত্র প্রার্থী। কেউই ভাবেনি তিনি বিজয়ী হতে চলেছেন।

তবে ক্যাম্পাসে নুর বেশ পরিচিত ছিলেন। ক্যাম্পাসে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন।

নির্বাচন শেষে দেখা গেল নূর ১১ হাজার ৬২টি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর চেয়ে ২ হাজার ভোট কম পায়।

স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো কোনো প্যানেল ছাড়াই কেউ ডাকসু-র ভিপি পদ জিতলেন।

নূর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে একাধিক প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন।

ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে থেকেই নূর আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়েন। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে এই ধারা চলতে থাকে। শক্তিশালী বিরোধীদলের উপস্থিতি না থাকায় আওয়ামী লীগের সামনে কিছু সময়ের জন্য নূরই এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।

গত বছর গণঅভ্যুত্থানের আগে কোটা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে নূরকে সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতার আবারও দেখায়, আওয়ামী লীগ তাকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করত।

সম্ভবত নুরের ভাগ্যই ডাকসু-র ভবিষ্যত ব্যাখ্যা করতে পারে।

নির্বাচন বয়কট করা ও বাতিল চাওয়ার পুরোনো রীতিই কি আবার ব্যবহৃত হতে পারে? অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রথম বড় নির্বাচনটিই কি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি বলে লজ্জার মুখে পড়বে?

এক অপ্রত্যাশিত প্রতিযোগিতা?

২০১৯ সালে নির্বাচিত ডাকসু কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার চার বছর পরও পরবর্তী নির্বাচনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে ডাকসু নির্বাচন মাত্র ৩৭ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি নির্বাচন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছরে মাত্র ৮টি নির্বাচন হয়েছে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩-এ প্রতি বছর ডাকসু ও হল ইউনিয়ন নির্বাচনের কথা বলা আছে।

ক্ষমতায় থাকা দল সবসময় নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও, তারা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার পরই নির্বাচন করতে চায়। সাধারণত যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তখন আশা করা হয় যে তাদের সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনের শিক্ষার্থীরা ক্ষমতায় থাকবে।

কিন্তু একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সেই সমীকরণ বদলে দিতে পারে। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে নূরের জয়ের মধ্য দিয়েই তা প্রমাণিত হয়।

বিরোধীপক্ষও প্রায়ই প্রতিযোগিতার মাঠ সমান না থাকার অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছে। এবারও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ সামনে আসছে।

দুদিন আগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহে বাধা দিতে মব সৃষ্টি করা হয়েছে।

তিনি এক সম্মেলনে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস সরকারের অধীনে এমন পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হচ্ছে? কেন উচ্ছৃঙ্খল জনতা গ্রাম, মহল্লা ও জেলায় নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে?’

ক্যাম্পাস রাজনীতিতে শিবিরের বিরাজমান প্রভাব নিয়েও তেমন কোনো আলোচনা নেই। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডাকসু উভয়ই শিবিরের কব্জায় রয়েছে। ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

২০১৯ সালের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ডাকসুর শক্তি একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। এই শক্তি ভোটারদের মনে বেশ প্রভাব ফেলে। ডাকসু নির্বাচন কেমন হয় তা থেকে নতুন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে তার একটি ইঙ্গিত মিলবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই নির্বাচনে কতটা প্রভাব খাটায় তাও নজরে রাখতে হবে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক কর্মীদের যারা নিজেদের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারাও এই নির্বাচনে সক্রিয় হয়েছেন। তাদের ভূমিকাও পর্যবেক্ষণে আসা উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচনী আচরণবিধি অনুমোদনের বিষয়েও সমালোচনা এসেছে। আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, কেবল প্রার্থী ও যোগ্য ভোটাররাই নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন।

নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে এলে আরও নতুন বিতর্ক দেখা দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো— নির্বাচন বয়কট করা ও বাতিল চাওয়ার পুরোনো রীতিই কি আবার ব্যবহৃত হতে পারে? অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রথম বড় নির্বাচনটিই কি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি বলে লজ্জার মুখে পড়বে? নাকি অন্তর্বর্তী সরকার এই নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি মডেল হিসেবে স্থাপন করে ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করবে?

এটা সত্য যে ৯০-র দশক থেকে ডাকসুর প্রভাব কিছুটা কমেছে। তবে ২০১৯ সালের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ডাকসুর শক্তি একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। এই শক্তি ভোটারদের মনে বেশ প্রভাব ফেলে। ডাকসু নির্বাচন কেমন হয় তা থেকে নতুন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে তার একটি ইঙ্গিত মিলবে।

এই বার্তার গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না।

তাই সবার নজর এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত