leadT1ad

ফুলগাজীর আশ্রয়কেন্দ্র

‘মাথার ওঁচে ছাদ থাইকলেই কি ঘর হয়’

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ২০: ৪০
ফুলগাজীর একটি আশ্রয়কেন্দ্র। স্ট্রিম ছবি

চল্লিশোর্ধ্ব বয়স মোতালেব মিয়ার। তাঁর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বন্যায় তলিয়ে গেছে তাঁর বসতভিটা, খেতখামার। স্ত্রী-সন্তানসহ উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। হাতে একেবারেই টাকাপয়সা নেই। স্ত্রীর জন্য জরুরি ওষুধও কিনতে পারছেন না। সন্তানের জন্য ব্যবস্থা করা হয়নি প্রয়োজনীয় খাবারের।

কান্না জড়ানো কণ্ঠে মোতালেব মিয়া বলেন, ‘এই বয়সে ঘরছাড়া অইছি। (বুধবার) রাইত ১২টায় আইছি। বউয়ের জন্য ওষুধ কিনমু কেন্নে। পেট খালি, হোলাহাইনে কান্দে।’ কান্না লুকিয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলের এই দোতলায় উঠছি, কিন্তু মাথার ওঁচে ছাদ থাইকলেই কি ঘর হয়?’

মোতালেবের মতো দুই সন্তান নিয়ে আশ্রায়কেন্দ্রে উঠেছেন লিপি বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি উঠেছেন মুন্সীরহাট আলী আজম উচ্চবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায়। বন্যায় তলিয়ে গেছে তাঁর ঘরবাড়ি। তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ আর হাহাকার। লিপি বলেন, ‘ছোডবেলাতুন দেখি এই হানির ঝামেলা। গতবারও এই দোতলায় উইঠছিলাম। এবার আবার আইলাম। কিন্তু কয় দিন থাকমু? ঘরে তো হানি, আর ইয়ানে খানা নাই, হুইতবার জায়গা অইলেই হোতন যায় না।’ লিপি বেগমের প্রশ্ন, ‘এই স্কুল যদি একদিন ডুবি যায়, আন্ডা তন কন্ডে যামু?’

আশ্রয় নেওয়া এই মানুষদের মতোই উপজেলার ফুলগাজী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ও মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। গত বছরের বন্যা সুলতানার বাড়িঘর সব নিয়ে গেছে, ভালোবাসা হিসেবে রেখে গেছে একটি পুত্রসন্তান। এবারের বন্যায় সেই সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

শুধু লিপি বেগম কিংবা মোতালেব মিয়া নন, এ গল্প আশ্রয়কেন্দ্রে আসা সবার। তাঁদের ভাষায়, পানি নেমে গেলেও শুরু হবে নতুন করে বাচাঁর লড়াই। আমজাদহাট, জিএমহাট, মুন্সিরহাট, দরবারপুরসহ উপজেলার সব ইউনিয়নের মানুষ পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচে গত কয়েক বছর।

ভারী বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানিতে গত বছরের মতো চলতি বছরও বন্যা কবলিত হয়েছে ফেনীর ফুলগাজীবাসী। উপজেলার ৮৫টি গ্রামে শুধু পানি আর পানি। মুহুরী, সিলোনিয়া ও কহুয়া নদীর দেড়পাড়া, উত্তর শ্রীপুর, দৌলতপুরসহ আটটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। পানির তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে ঘরের চাল ও বেড়া। গ্রামের হতদরিদ্র কিছু লোকজন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে দোতলায় আশ্রয় নিয়েছেন। ছোট্ট কক্ষে গাদাগাদি করে থাকছে কয়েকটি পরিবার। এই দুর্যোগের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে এসেছেন ৭৫ বছর বয়সী উত্তর শ্রীপুরের আবুল কাশেম, ৩২ বছরের কাওসার সুলতানা কিংবা চল্লিশোর্ধ্ব মোতালেব মিয়া।

উপজেলার নতুন মুন্সীরহাট আজমেরী বেগম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও তার আশপাশের খোলা বাজারে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। এ সব পরিবারের মতো বানের জলে আসা ফুলগাজীর সহস্রাধিক হতদরিদ্র পরিবারের ঠাঁই হয়েছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে।

এসব পরিবারের কয়েকজন বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে যা আছে, তা অনেক সময় নিরাপদ নয়। নেই আলাদা নারীকক্ষ, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিশুদের প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা। অনেক সময় খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। বরাদ্দ আসে, কিন্তু তা সবার কাছে পৌঁছায় না।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁধ মেরামত বা টেকসই প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, তাঁরা একটা টেকসই বাঁধ চান। নইলে এই মরার খেলা চলতেই থাকবে।

মুন্সীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আজমেরী বেগম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে আশ্রিতদের খোঁজ নেওয়া হয়েছে। আশ্রিতদের খাবার ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জানা গেছে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম সদরের আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির নেতারা আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করে খাবার বিতরণ করেছেন।

জেলায় ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৬৫০ পরিবারের ৬ হাজার ৯৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফুলগাজী উপজেলায় ৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩২টি, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৭টি। শুকনা খাবার বিতরণে প্রশাসন এরই মধ্যে ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে।

বিষয়:

বন্যা
Ad 300x250

সম্পর্কিত