leadT1ad

আইসিডিডিআর,বির গবেষণা

‌‌‌‌ঢাকার ২-৪ বছর বয়সী ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তেই উদ্বেগজনক মাত্রায় সীসা

স্ট্রিম ডেস্কঢাকা
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ২৮
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ৩৫
ছবি- আইসিডিডিআর,বির গবেষণা প্রতিবেদন থকে নেওয়া

রাজধানীতে বসবাসকারী দুই থেকে চার বছর বয়সী ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তেই উদ্বেগজনক মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ২০২২-২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল এমন তথ্য পেয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআর,বি। সংস্থাটির অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট ডা. জেসমিন সুলতানা এক আলোচনা সভায় গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

আজ বুধবার (৬ আগস্ট) শিশুদের সীসা দূষণ থেকে বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আইসিডিডিআর,বি ‌‘বাংলাদেশে সীসা দূষণ প্রতিরোধ: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে সীসা দূষণের ব্যাপকতা ও এর ভয়াবহতা তুলে ধরা এবং এর থেকে মুক্তির উপায়গুলো আলোচনা করা।

আলোচনা সভায় ডা. জেসমিন সুলতানা জানান, ঢাকায় পরিচালত এই গবেষণায় দুই থেকে চার বছর বয়সী ৫০০ জন শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিটি শিশুর রক্তেই সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৯৮ শতাংশ শিশুর প্রতি লিটার রক্তেই সিডিসির উদ্বেগজনক মাত্রা ৩৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি সীসা ছিল। এছাড়া মধ্যমমাত্রায় প্রতি লিটার রক্তে ৬৭ মাইক্রোগ্রাম সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

শিল্প স্থাপনার এলাকায় সীসার মাত্রা বেশি

এই গবেষণায় চিহ্নিত সীসা-নির্ভর শিল্প স্থাপনার ১ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সীসার মাত্রা ছিল ৫ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। সীসার অন্যান্য উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘরের ভেতরে ধূমপান, দূষিত ধূলিকণা, সীসাযুক্ত প্রসাধনী সামগ্রী ও রান্নার পাত্র।

এই আলোচনা সভা থেকে সীসা-নির্ভর শিল্প স্থাপনা, যেমন: লেড-এসিড ব্যাটারি বানানো বা রিসাইক্লিং করার কারখানা বা স্থান, অথবা যেসব কারখানা বা স্থাপনায় সীসা গলানো বা পোড়ানো হয়, এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরিয়ে নিলে বা দূষণ কমানোর ব্যবস্থা নিলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিশুদের সীসা দূষণ থেকে বাঁচানো সম্ভব।

মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে সীসা

আইসিডিডিআর,বি-র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘সীসার বিষক্রিয়া নীরবে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেড়ে নিচ্ছে। এটি তাদের মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে এবং দেহে পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি করে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতকেই পিছিয়ে দেয়। তাই আমাদের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সীসা নিঃসরণকারী উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে, যাতে প্রতিটি শিশু সুস্থ ও বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে বেড়ে উঠে এবং দেশের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।‘

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং আইসিডিডিআর,বি-র সাবেক পরিচালক, প্রফেসর স্টিভ লুবি বলেন, সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে, যার ফলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা (আইকিউ) ও শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বাতাস নেই, যে খাবার খাই, যে দূষিত মাটি বা ধূলিকণা স্পর্শ করি এবং এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের প্লাসেন্টার মাধ্যমেও সীসা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এত বিভিন্ন উপায়ে সীসা প্রবেশ করে বলে, এর সংস্পর্শ থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভব, যদি না আমরা পরিবেশে এর মূল উৎসগুলো, বিশেষ করে যেগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তা বন্ধ করি।‘

‌রক্তে সীসার নিরাপদ মাত্রা কত?

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিডিডিআর,বি-র হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন-এর সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারাহ স্যালওয়ে। তিনি বলেন, ‌’সীসা দূষণ বাংলাদেশের একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। বিশেষ করে দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানার আশপাশের শিশুরা এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।‘

সীসা একটি বিষাক্ত ভারী ধাতু, যা নীরবে লক্ষ লক্ষ মানুষের, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে। রক্তে সীসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) শিশুদের রক্তে প্রতি লিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সীসার উপস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মনে করে।

সীসা দূষণে বাংলাদেশে অবস্থান কোথায়

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে সীসা দূষণে আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু রক্তে উচ্চ মাত্রার সীসা নিয়ে জীবনধারণ করছে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত আরেকটি গবেষণায় দেখানো হয়, ২০০৯–২০১২ সালের মধ্যে ঢাকার বস্তি এলাকায় ২ বছরের কম বয়সী ৮৭ শতাংশ শিশুর রক্তে প্রতি লিটারে সীসার মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি ছিল, যা তাদের শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার একটি প্রধান কারণ।

আইসিডিডিআর,বি-র প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর ডা. মো. মাহবুবুর রহমান গত ১০ বছরের সীসা-সম্পর্কিত গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সীসা দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সীসা ও ব্যাটারি-সম্পর্কিত শিল্প-কারখানা, সীসাযুক্ত রঙ এবং প্রসাধনী ও রান্নার পাত্রের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

তবে আশার কথা হলো, রান্নায় ব্যবহৃত হলুদে ভেজাল (লেড ক্রোমেট দিয়ে পালিশ করা) প্রতিরোধে বেশ সফলতা এসেছে। আইসিডিডিআর,বি ও স্ট্যানফোর্ডের একটি গবেষণা দল গর্ভবতী মহিলাদের রক্তে সীসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে রান্নায় ব্যবহৃত হলুদের গুঁড়াকে চিহ্নিত করার পর, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে এই বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলে, ২০১৯ সালে যেখানে ৪৭ শতাংশ রান্নার হলুদের নমুনায় সীসা পাওয়া যেত, তা কমে ২০২১ সালে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে।

এই আলোচনা সভায় আইসিডিডিআর,বি ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক এবং বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমের সাংবাদিকরা অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের শিশুদের জন্য একটি সুস্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে সভাটি শেষ হয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত