leadT1ad

বন্ধের ২৩ বছর আজ

যে কারণে বন্ধ হয়েছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুট মিল

২০০২ সালের ৩০ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুট মিল। কেন বন্ধ করে দেওয়া হয় মিলটি?

তুফায়েল আহমদ
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ২১: ০৯
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

এক সময় নারায়ণগঞ্জ ছিল পাটশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। আর নারায়ণগঞ্জের মধ্যবিন্দু ছিল আদমজী জুট মিল। স্কটল্যান্ডের ডান্ডি যেমন পাট ব্যবসার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল, তেমনি নারায়ণগঞ্জকেও বলা হতো ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’। শিল্প ও বাণিজ্যে সোনালি আঁশের এই জৌলুস আজ শুধুই ইতিহাস।

২৩ বছর আগে আজকের এই দিনে বন্ধ করে দেওয়া হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ২০০২ সালের ৩০ জুন তৎকালীন সরকার মিলটি বন্ধ করে দেয়। পরে ২০০৬ সালের ৬ মার্চে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেই থেকে এ মিলের ২ শ ৯১ একর জমি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে আদমজী ইপিজেড। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর জুট মিলের দ্বিতীয় ইউনিট পুনরায় চালুর ঘোষণা দেয়। তবে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনকালে এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।

আদমজীর ইতিহাস

১৯৫০ সালে পাকিস্তানের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই এ ওয়াহেদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ যৌথভাবে আদমজী জুট মিল প্রতিষ্ঠা করেন। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়ায় ২৯৭ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে এই ঐতিহ্যবাহী মিল। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে শুরু হয় উৎপাদন। সে সময় প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো মিলটি থেকে। একই বছর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বসানো হয় ৩ হাজার ৩০০টি তাঁতকলও।

আদমজী জুট মিলের উৎপাদিত চট, কার্পেটসহ অন্যান্য পণ্য দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি হতে শুরু করে ভারত, চীন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এবং এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল হিসেবে এ মিলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি বাড়তে থাকে উৎপাদনও। শীতলক্ষ্যার দুই পার—সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও সোনারগাঁয়ে গড়ে ওঠে পাটকল কেন্দ্রিক বিশাল জনবসতি।

১৯৬৪ সালে বেশি পরিমাণে হেসিয়ান কাপড় উৎপাদনের জন্য আদমজী মিলে ১২৮টি ব্রড লুম যোগ করা হয়। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হেসিয়ান কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিল।

আদমজী পাটকলের ভিতরের যন্ত্রাংশ। ছবি: বাংলাদেশ পুরাতন ফটো আর্কাইভ।
আদমজী পাটকলের ভিতরের যন্ত্রাংশ। ছবি: বাংলাদেশ পুরাতন ফটো আর্কাইভ।

পরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আদমজী জুট মিলকে জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে এই মিলসহ ৮২টি বেসরকারি পাটকল জাতীয়করণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। মূলত এ সময় থেকেই দেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার জনপ্রিয় হতে থাকে। ফলে পাটকলগুলোর স্বর্ণযুগের সূর্যও অস্তমিত হতে শুরু করে ধীরে ধীরে। পরবর্তীকালে আশির দশকে দু-এক বছর বাদে প্রায় সব সময়ই বিপুল ক্ষতির মুখোমুখি হয় মিলটি।

বাঙালি–বিহারি সংঘর্ষ

আদমজী জুট মিলে বিভিন্ন সময়ে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৫৪ সালের মে মাসের বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যকার একটি সহিংস ঘটনা। দুই শ্রমিকের তর্ক-বিতর্ক থেকে সৃষ্ট এ সংঘর্ষে ৯০ জন নিহত এবং ২৫০ জন আহত হন। মিলটিতে তখন ১৮ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি তিন শ সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়। যদিও তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

বন্ধের কারণ

আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ‘অব্যবস্থাপনা’। বিজেএমসি পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে সামাল দিতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা দরকার, বাংলাদেশের পাটকলগুলোর মধ্যে আদমজীতেই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ও কর্মচারী কাজ করতেন। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির ফলে মিলটি ক্রমাগত লোকসানের শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও প্রচুর পরিমাণে অদক্ষ কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগও ছিল। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বাড়তে থাকে অপরাধের ঘটনাও। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে উৎপাদনে।

যখন বাংলাদেশের পাটকলগুলো দুর্নীতি আর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিনিয়ত লোকসানের মুখে পড়ছিল, ঠিক তখনই ভারত তাদের পাটশিল্পের উন্নয়ন শুরু করে। বাংলাদেশে চাষ করা পাটের মান তুলনায় ভালো হলেও উৎপাদনের আধুনিকায়ন এবং ধারাবাহিকতার ফলে প্রতিবেশী দেশটি দ্রুতই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে। যাঁরা বাংলাদেশ থেকে পাট বা পাটজাত পণ্য কিনতেন, তাঁরাই এবার ভারত থেকে পণ্য কিনতে শুরু করেন।

এখানে আরেকটি ব্যাপারও ছিল। ভারত ও চীন যখন অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে পাটপণ্য তৈরি করে দ্রুত নিজেদের কাজের পরিধি বিস্তৃত করছিল, বাংলাদেশ তখনো ব্যবহার করছিল ব্রিটিশ শাসনামলের পুরোনো প্রযুক্তির মেশিন। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ নতুন কোনো উদ্ভাবন আনতে ব্যর্থ হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব বাজারে হ্রাস পেতে থাকে দেশের পাটজাত পণ্যের চাহিদা। এসব কারণেই ঐতিহ্যবাহী আদমজী জুট মিল এবং অন্যান্য পাটকল বন্ধ হওয়ার পরিণতি ঘটে।

২০০২ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় আদমজী জুট মিল। এ সময় তৎকালীন পাটমন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আদমজী জুট মিল গত ৩০ বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা (১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড) ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে এই বোঝা আর বহন করা সম্ভব নয়।’

যদিও কিছু অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের পাটশিল্প ধ্বংস করে চিরকাল বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল আদমজীসহ এই জুট মিলগুলো।

আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ার সময় কর্মরত ছিলেন প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। বিদায়বেলায় তাঁদের বকেয়া বেতন বাবদ ৩৫ কোটি ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। তবে বেতন পেলেও চাকরি হারিয়ে জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তায় পড়ে যান শ্রমিকেরা। মিল বন্ধের দীর্ঘ ২৩ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। প্রতি বছর ৩০ জুন এলে আদমজীর সাবেক শ্রমিকেরা স্মরণ করেন হারানো দিনগুলোকে।

বিষয়:

ইতিহাস
Ad 300x250

সম্পর্কিত