মামলার পক্ষরা নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। আইনজীবী নিয়োগের দরকার নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।
আহমেদ আল আমীন
ছোটখাটো বিরোধ, পাওনা টাকা বা প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা—এসব নিয়ে থানায় কিংবা জেলা আদালতে ছুটে বেড়াতে হয় না। দীর্ঘসূত্রতা, খরচ আর দালালের হয়রানির ঝুঁকি ছাড়াই এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত গ্রাম আদালতে। আপনার ইউনিয়ন পরিষদেই বসে এই আদালত, যেখানে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে মিটতে পারে নানা বিরোধ। আপনাকে শুধু সেই আদালতে যেতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারপরই বসবে সেই আদালত। মামলার পক্ষরা নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। আইনজীবী নিয়োগের দরকার নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সালিসের আইনগত ও আনুষ্ঠানিক রূপ হলো গ্রাম আদালত। তবে প্রচলিত সাধারণ আদালত ব্যবস্থার সঙ্গে এর বিরোধ নেই, বরং পরিপূরক। গ্রাম আদালত অনানুষ্ঠানিক আদালত হলেও এর আইনগত ভিত্তি রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ছোটো ছোটো সমস্যা সমাধানে গ্রাম আদালত বিরোধ নিষ্পত্তির একটা কার্যকর ব্যবস্থা। মামলা করলেই গ্রাম আদালত গঠিত হয়। স্বল্প সময়ে ও খরচে বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। ১৯৭৬ সাল থেকে আইনের মাধ্যমে গ্রাম আদালত প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৬ সালে আইন সংশোধন এবং ২০১৬ সালে বিধিমালা প্রণয়নের পর গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কিছু দেওয়ানি এবং ফৌজদারি বিবাদ বা বিরোধের সহজ ও দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠিত আদালতই গ্রাম আদালত। বর্তমানে দেশের ৬১টি জেলার ৪ হাজার ৪৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে, অনেকেই এই আদালত ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানে না।
যেমন, কিশোরগঞ্জের রাজিয়া আক্তার। বয়স ৩৮ বছর। এই বিধবা কটিয়াদি উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুরে থাকেন। হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। আয় বাড়াতে মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। ২০০৯ সালের মে মাসে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে এবং অন্যান্য গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে প্রতিবেশী মালেকা বেগমকে আট হাজার টাকা ধার দেন। আট মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধের কথা ছিলো। দেনা পরিশোধের জন্য মালেকা পরে আরো সময় চাইলে রাজিয়া অতিরিক্ত ছয় মাস সময় দেন। এরপর থেকে রাজিয়া বারবার তাগিদ দিলেও মালেকা এক পয়সাও দেননি। এরই মধ্যে কেটে গেছে তিনটি বছর। অসহায় রাজিয়া ২০১২ সালের মে মাসে স্থানীয় সালিশে আবেদন করলেও কোন সুরাহা হয়নি। হঠাৎ করেই তিনি ইউপি সদস্য রুহুল আমিনের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি রাজিয়াকে গ্রাম আদালত এবং এর পরিষেবা সম্পর্কে জানান; সেখানে প্রতিকার চাইতে উৎসাহিত করেন।
রাজিয়া ২০১২ সালের ১ জুলাই চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদে মালেকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। গ্রাম আদালতের সহকারী আবেদনটি ফৌজদারি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেন। ওই বছরের ২২ আগস্ট মামলার শুনানি হয়। সেখানে উভয় পক্ষ উপস্থিত ছিলো। বিবাদী মালেকা অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেননি। আদালত অভিযোগটি ন্যায্য বলে মনে করে। গ্রাম আদালত ৩০ দিনের মধ্যে রাজিয়ার কাছে মালেকা বেগমকে টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেয়।
আদালত রাজিয়ার পাওনা আট হাজার টাকাই ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছিলো। তবে মালেকার অনুরোধ এবং আর্থিক দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে, রাজিয়া দুই হাজার টাকা মওকুফ করেন। সেই অনুযায়ী মালেকা বাদীকে ছয় হাজার টাকা ফেরত দেন। রাজিয়া মনে করেন, গ্রাম আদালতের পরিষেবা কেবল তাকে টাকা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেনি বরং তার প্রতিবেশী মালেকার সঙ্গে ভাঙা সম্পর্ক পুনরুদ্ধারেও সহায়তা করেছে।
গ্রাম আদালতে কেন যাবেন?
গ্রাম আদালতে স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে সহজে বিরোধ ও বিবাদ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। প্রতিনিধি মনোনয়নে আবেদনকারী ও বিবাদী সমান সুযোগ পায়। মামলার পক্ষরা নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। আইনজীবী নিয়োগের দরকার নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। একটি বিরোধ থেকে একাধিক বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা কম। উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণ, বিশেষ করে নারী, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সহজে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পায়।
গ্রাম আদালত কোন কোন বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে?
গ্রাম আদালত দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকার বিরোধ ও মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে। ফৌজদারি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে চুরি, দাঙ্গা, প্রতারণা, ঝগড়া, মারামারি, মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাৎ, অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ও আটক, ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি, নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা বা অপমানের উদ্দেশ্যে কথা বলা, অঙ্গভঙ্গি বা অন্য কোনো কাজ করা। অন্যদিকে দেওয়ানি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে পাওনা টাকা আদায়, স্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, অস্থাবর সম্পত্তি জবরদখল বা ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়, গবাদি পশু অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত, কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায়, স্ত্রীর ভরণপোষণ আদায় প্রভৃতি। তবে, গ্রাম আদালত ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, ডাকাতি, বহুবিবাহ, তালাক, অভিভাবকত্ব, দেনমোহর, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, কোনো ঘটনায় রক্তপাত সংঘটিত হলে, স্থাবর সম্পত্তির স্বত্বাধিকার সংক্রান্ত এবং তিন লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে না।
কীভাবে আবেদন দাখিল করতে হয়
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংগৃহীত ফরম পূরণ করে আবেদনপত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে হবে। এ সময় ফৌজদারি মামলার জন্য দশ টাকা ও দেওয়ানি মামলার জন্য ২০ টাকা ফি দিতে হবে, রশিদও নিতে হবে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে বিরোধ সংঘটনের ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করতে হবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে এই সময় ৬০ দিন। তবে, স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হওয়ার দিন থেকে এক বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। শুনানি শুরু হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হয়।
গ্রাম আদালত গঠন
একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এবং বাদী ও বিবাদীপক্ষে মনোনীত দুই জন করে মোট পাঁচজনের সমন্বয়ে এই আদালত গঠিত হবে। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোনো সদস্য গ্রাম আদালতের দায়িত্ব পালন করবেন। নারী সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রাম আদালতে প্যানেল সদস্য হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে এজলাস ব্যবহার করে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। তবে আদালত উপযুক্ত মনে করলে মামলার যে কোনো পর্যায়ে বিবাদের কোনো বিষয় জানতে স্থানীয়ভাবে পরিদর্শন করতে পারবে।
এখতিয়ার ও ক্ষমতা
গ্রাম আদালত আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ নিয়ে থানায় কিংবা আদালতে মামলা হলেও কোর্ট (জেলা আদালত) থেকে মামলাগুলো গ্রাম আদালতে পাঠানো হয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি মামলা কোর্ট (জেলা আদালত) থেকে ইউনিয়ন পরিষদে পাঠানো হয়েছে। কোর্ট থেকে পাঠানো মামলার ক্ষেত্রে কোনো ফি দরকার হয় না।
গ্রাম আদালত এখতিয়ারভুক্ত ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে অনধিক তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে অনধিক তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারবে। অথবা সম্পত্তির প্রকৃত মালিকের কাছে সম্পত্তি বা তার দখল ফেরত দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে। সাক্ষ্য-প্রমাণ হাতের কাছে, কোনো পক্ষ চাইলেও কোনো কিছু গোপন করতে পারে না। সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হলে অথবা ৪:১ কিংবা ৩:১ বা ৩:০ হলে আপিল চলে না। মিথ্যা মামলা দায়ের করলে দায়ী ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যায়। সাক্ষী ইচ্ছা করে সমন অমান্য করলেও জরিমানার বিধান রয়েছে। এই আদালতকে অবমাননা করলেও এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। গ্রাম আদালত সাধারণ অন্য আদালতের মামলাজট কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে ২০০৯ সাল থেকে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্প চালু রয়েছে। ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটি চলমান। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৫৯ হাজার মামলার সমাধান হয়েছে। গ্রাম আদালত বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সেখানে ইউএনডিপির লিগ্যাল এনালিস্ট, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, গ্রাম আদালতের উদ্দেশ্য বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে উভয়পক্ষের সম্পর্কের পুনর্মিলন ঘটানো, শাস্তি দেওয়া নয়। গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে আরো জোরালো করা গেলে বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ বাঁচবে। এই আদালতে অধিকাংশ মামলা প্রাথমিক পর্যায় বা প্রাক বিচার পর্যায়েই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবির ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, আমাদের দেশের আদালতগুলোতে লাখ লাখ মামলা বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা মামলাজট কমানো ও বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য আশার আলো হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত মামলা এখানেই দায়ের ও নিষ্পত্তি করা উচিত।
ছোটখাটো বিরোধ, পাওনা টাকা বা প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা—এসব নিয়ে থানায় কিংবা জেলা আদালতে ছুটে বেড়াতে হয় না। দীর্ঘসূত্রতা, খরচ আর দালালের হয়রানির ঝুঁকি ছাড়াই এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত গ্রাম আদালতে। আপনার ইউনিয়ন পরিষদেই বসে এই আদালত, যেখানে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে মিটতে পারে নানা বিরোধ। আপনাকে শুধু সেই আদালতে যেতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারপরই বসবে সেই আদালত। মামলার পক্ষরা নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। আইনজীবী নিয়োগের দরকার নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সালিসের আইনগত ও আনুষ্ঠানিক রূপ হলো গ্রাম আদালত। তবে প্রচলিত সাধারণ আদালত ব্যবস্থার সঙ্গে এর বিরোধ নেই, বরং পরিপূরক। গ্রাম আদালত অনানুষ্ঠানিক আদালত হলেও এর আইনগত ভিত্তি রয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ছোটো ছোটো সমস্যা সমাধানে গ্রাম আদালত বিরোধ নিষ্পত্তির একটা কার্যকর ব্যবস্থা। মামলা করলেই গ্রাম আদালত গঠিত হয়। স্বল্প সময়ে ও খরচে বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। ১৯৭৬ সাল থেকে আইনের মাধ্যমে গ্রাম আদালত প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৬ সালে আইন সংশোধন এবং ২০১৬ সালে বিধিমালা প্রণয়নের পর গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কিছু দেওয়ানি এবং ফৌজদারি বিবাদ বা বিরোধের সহজ ও দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠিত আদালতই গ্রাম আদালত। বর্তমানে দেশের ৬১টি জেলার ৪ হাজার ৪৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে, অনেকেই এই আদালত ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানে না।
যেমন, কিশোরগঞ্জের রাজিয়া আক্তার। বয়স ৩৮ বছর। এই বিধবা কটিয়াদি উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুরে থাকেন। হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। আয় বাড়াতে মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। ২০০৯ সালের মে মাসে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে এবং অন্যান্য গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে প্রতিবেশী মালেকা বেগমকে আট হাজার টাকা ধার দেন। আট মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধের কথা ছিলো। দেনা পরিশোধের জন্য মালেকা পরে আরো সময় চাইলে রাজিয়া অতিরিক্ত ছয় মাস সময় দেন। এরপর থেকে রাজিয়া বারবার তাগিদ দিলেও মালেকা এক পয়সাও দেননি। এরই মধ্যে কেটে গেছে তিনটি বছর। অসহায় রাজিয়া ২০১২ সালের মে মাসে স্থানীয় সালিশে আবেদন করলেও কোন সুরাহা হয়নি। হঠাৎ করেই তিনি ইউপি সদস্য রুহুল আমিনের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি রাজিয়াকে গ্রাম আদালত এবং এর পরিষেবা সম্পর্কে জানান; সেখানে প্রতিকার চাইতে উৎসাহিত করেন।
রাজিয়া ২০১২ সালের ১ জুলাই চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদে মালেকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। গ্রাম আদালতের সহকারী আবেদনটি ফৌজদারি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেন। ওই বছরের ২২ আগস্ট মামলার শুনানি হয়। সেখানে উভয় পক্ষ উপস্থিত ছিলো। বিবাদী মালেকা অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেননি। আদালত অভিযোগটি ন্যায্য বলে মনে করে। গ্রাম আদালত ৩০ দিনের মধ্যে রাজিয়ার কাছে মালেকা বেগমকে টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেয়।
আদালত রাজিয়ার পাওনা আট হাজার টাকাই ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছিলো। তবে মালেকার অনুরোধ এবং আর্থিক দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে, রাজিয়া দুই হাজার টাকা মওকুফ করেন। সেই অনুযায়ী মালেকা বাদীকে ছয় হাজার টাকা ফেরত দেন। রাজিয়া মনে করেন, গ্রাম আদালতের পরিষেবা কেবল তাকে টাকা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেনি বরং তার প্রতিবেশী মালেকার সঙ্গে ভাঙা সম্পর্ক পুনরুদ্ধারেও সহায়তা করেছে।
গ্রাম আদালতে কেন যাবেন?
গ্রাম আদালতে স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে সহজে বিরোধ ও বিবাদ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। প্রতিনিধি মনোনয়নে আবেদনকারী ও বিবাদী সমান সুযোগ পায়। মামলার পক্ষরা নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। আইনজীবী নিয়োগের দরকার নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। একটি বিরোধ থেকে একাধিক বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা কম। উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণ, বিশেষ করে নারী, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সহজে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পায়।
গ্রাম আদালত কোন কোন বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে?
গ্রাম আদালত দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকার বিরোধ ও মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে। ফৌজদারি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে চুরি, দাঙ্গা, প্রতারণা, ঝগড়া, মারামারি, মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাৎ, অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ও আটক, ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি, নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা বা অপমানের উদ্দেশ্যে কথা বলা, অঙ্গভঙ্গি বা অন্য কোনো কাজ করা। অন্যদিকে দেওয়ানি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে পাওনা টাকা আদায়, স্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, অস্থাবর সম্পত্তি জবরদখল বা ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়, গবাদি পশু অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত, কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায়, স্ত্রীর ভরণপোষণ আদায় প্রভৃতি। তবে, গ্রাম আদালত ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, ডাকাতি, বহুবিবাহ, তালাক, অভিভাবকত্ব, দেনমোহর, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, কোনো ঘটনায় রক্তপাত সংঘটিত হলে, স্থাবর সম্পত্তির স্বত্বাধিকার সংক্রান্ত এবং তিন লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে না।
কীভাবে আবেদন দাখিল করতে হয়
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংগৃহীত ফরম পূরণ করে আবেদনপত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে হবে। এ সময় ফৌজদারি মামলার জন্য দশ টাকা ও দেওয়ানি মামলার জন্য ২০ টাকা ফি দিতে হবে, রশিদও নিতে হবে। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে বিরোধ সংঘটনের ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করতে হবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে এই সময় ৬০ দিন। তবে, স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হওয়ার দিন থেকে এক বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। শুনানি শুরু হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হয়।
গ্রাম আদালত গঠন
একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এবং বাদী ও বিবাদীপক্ষে মনোনীত দুই জন করে মোট পাঁচজনের সমন্বয়ে এই আদালত গঠিত হবে। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোনো সদস্য গ্রাম আদালতের দায়িত্ব পালন করবেন। নারী সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রাম আদালতে প্যানেল সদস্য হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে এজলাস ব্যবহার করে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। তবে আদালত উপযুক্ত মনে করলে মামলার যে কোনো পর্যায়ে বিবাদের কোনো বিষয় জানতে স্থানীয়ভাবে পরিদর্শন করতে পারবে।
এখতিয়ার ও ক্ষমতা
গ্রাম আদালত আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ নিয়ে থানায় কিংবা আদালতে মামলা হলেও কোর্ট (জেলা আদালত) থেকে মামলাগুলো গ্রাম আদালতে পাঠানো হয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি মামলা কোর্ট (জেলা আদালত) থেকে ইউনিয়ন পরিষদে পাঠানো হয়েছে। কোর্ট থেকে পাঠানো মামলার ক্ষেত্রে কোনো ফি দরকার হয় না।
গ্রাম আদালত এখতিয়ারভুক্ত ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে অনধিক তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে অনধিক তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারবে। অথবা সম্পত্তির প্রকৃত মালিকের কাছে সম্পত্তি বা তার দখল ফেরত দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে। সাক্ষ্য-প্রমাণ হাতের কাছে, কোনো পক্ষ চাইলেও কোনো কিছু গোপন করতে পারে না। সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হলে অথবা ৪:১ কিংবা ৩:১ বা ৩:০ হলে আপিল চলে না। মিথ্যা মামলা দায়ের করলে দায়ী ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যায়। সাক্ষী ইচ্ছা করে সমন অমান্য করলেও জরিমানার বিধান রয়েছে। এই আদালতকে অবমাননা করলেও এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। গ্রাম আদালত সাধারণ অন্য আদালতের মামলাজট কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে ২০০৯ সাল থেকে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্প চালু রয়েছে। ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটি চলমান। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৫৯ হাজার মামলার সমাধান হয়েছে। গ্রাম আদালত বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সেখানে ইউএনডিপির লিগ্যাল এনালিস্ট, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, গ্রাম আদালতের উদ্দেশ্য বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে উভয়পক্ষের সম্পর্কের পুনর্মিলন ঘটানো, শাস্তি দেওয়া নয়। গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে আরো জোরালো করা গেলে বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ বাঁচবে। এই আদালতে অধিকাংশ মামলা প্রাথমিক পর্যায় বা প্রাক বিচার পর্যায়েই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবির ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, আমাদের দেশের আদালতগুলোতে লাখ লাখ মামলা বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা মামলাজট কমানো ও বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য আশার আলো হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত মামলা এখানেই দায়ের ও নিষ্পত্তি করা উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) নিয়ে কুষ্টিয়ার জামায়াতে ইসলামী নেতা মুফতি আমির হামজার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আজ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
৪৪ মিনিট আগেনির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে ঠেকানো যাবে না, বরং ট্রাইব্যুনালে বিচারের মাধ্যমে এই দলকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহবায়ক নাহিদ ইসলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য শেষে আজ রোববার সাংবাদ
১ ঘণ্টা আগেরাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ আরও দুজন রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। আজ রোববার দুপুরে দুর্ঘটনার দুই মাস পূর্তির দিনে ছাড়পত্র পাওয়া দুজন হলো, নিলয় (১৩) ও রুপি বড়ুয়া (১০)।
১ ঘণ্টা আগেজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে বদলি করা হয়েছে। তাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগে