leadT1ad

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি-চেইন ব্র্যান্ড স্টারবাকস কেন আজ সংকটে

আমেরিকান বহুজাতিক কফিহাউস স্টারবাকস বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি-চেইন ব্র্যান্ড। সেই স্টারবাকসই এখন নানা সমস্যায় পড়েছে, টলমল করছে তাদের বহু বছরের আধিপত্য। বিজনেস ওয়ার্ল্ডের এই সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো তাদের ধারাবাহিক মন্দা ও ব্র্যান্ড-ধাক্কা। কিন্তু কেন?

মিনহাজ রহমান পিয়াস
মিনহাজ রহমান পিয়াস

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৪১
স্ট্রিম গ্রাফিক

বিজনেস ওয়ার্ল্ডের এই সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো স্টারবাকস কফির ধারাবাহিক মন্দা ও ব্র্যান্ড-ধাক্কা। কফি পছন্দ করেন কিন্তু স্টারবাকসের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। প্রথম সারির বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর তালিকা দেখলে সেখানে দেখা যাবে স্টারবাকসের নাম। স্টারবাকসের কফি কাপ হাতে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করা, কফিতে চুমুক দিতে দিতে অফিসে ঢোকাটা শুধু ট্রেন্ডিই না, বরং হাল জমানার স্টাইলও বটে। সেই স্টারবাকসই এখন নানা সমস্যায় পড়েছে, টলমল করছে তাদের বহু বছরের আধিপত্য।

গল্পটা শুরু ১৯৬২ সালে। আমেরিকার নাগরিক গর্ডন বোকার ইতালির মিলানে বেড়াতে গিয়ে এক ভিন্ন স্বাদের কফি পান করেন। সেই স্বাদ তার মনে দাগ কেটে যায়। ফিরে এসে তিনি বন্ধু জেরি বোল্ডউইন ও জেভ সিগলের সঙ্গে নতুন এক ব্যবসার কথা ভাবেন। তখনও আমেরিকায় ভালো মানের রোস্টেড কফির চল শুরু হয়নি। বেশিরভাগ ক্যাফেতেই সস্তা ও নিম্নমানের কফি পাওয়া যেত। তাঁরা সুযোগ দেখলেন সেখানেই। আর সেই ভাবনা থেকেই ১৯৭১ সালে সিয়াটলে জন্ম নেয় স্টারবাকস।

স্টারবাকস শুরুতে রেডিমেড কফি বিক্রি করত না। তারা মূলত খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারিতে রোস্টেড কফি বিন বিক্রি করত। মান ভালো হওয়ায় খুব অল্প সময়েই তারা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮০ সাল নাগাদ সিয়াটলে তাদের চারটি আউটলেটও হয়ে যায়।

২০২৪ সালের স্টারবাকসের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বজুড়ে ৮০টিরও বেশি দেশে তাদের ৪০ হাজারের বেশি আউটলেট রয়েছে। সংগৃহীত ছবি
২০২৪ সালের স্টারবাকসের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বজুড়ে ৮০টিরও বেশি দেশে তাদের ৪০ হাজারের বেশি আউটলেট রয়েছে। সংগৃহীত ছবি

১৯৮২ সালে হাওয়ার্ড শুল্টজ যোগ দেন স্টারবাকসের মার্কেটিং হেড হিসেবে। তিনি খেয়াল করলেন স্টারবাকসের কিছু কর্মী ক্রেতাদের সঙ্গে বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে। পরের বছরই ১৯৮৩ সালে তিনি ইতালির মিলান শহরে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, মানুষ সেখানে কফিশপকে আড্ডার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। তিনি বুঝলেন শুধু কফি বিন বিক্রি করে স্টারবাকস বেশি দূর যেতে পারবে না। তাই রেডিমেড কফি বিক্রির প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু মালিকেরা রাজি হলেন না। ১৯৮৬ সালে শুল্টজ নিজেই স্টারবাকস ছাড়লেন এবং নিজের কফিশপ চালু করলেন।

এদিকে ততদিনে একে একে স্টারবাকসের মালিকেরা ব্যবসা ছাড়তে শুরু করেন। আর সেই সুযোগ কাজে লাগালেন শুল্টজ। ১৯৮৭ সালে কিছু বিনিয়োগকারীর সহায়তায় স্টারবাকস কিনে নেন তিনি। স্টারবাকসের প্রথম দিকে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের পরিবারের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করেছিল।

তখন স্টারবাকসের আউটলেট ছিল মাত্র ছয়টি। শুল্টজের কথা ছিল পরিষ্কার, মানুষ শুধু কফি খেতে আসে না, একটু সময় কাটাতেও আসে। তাই তিনি চাইলেন ‘থার্ড স্পেস’ আইডিয়াকে কাজে লাগাতে। মূল লক্ষ্য ছিল ক্রেতারা যাতে এই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে সেজন্য কফি শপে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করা। আরামদায়ক সোফা, ফায়ারপ্লেস, ক্যাফের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার মতো স্থান বা নীরবে কাজ করার জায়গা সহ আরও অনেক কিছু।

এরপর ক্রেতাদের সঙ্গে বিক্রয়কর্মীর সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিলেন শুল্টজ। একজন ক্রেতা শপে ঢুকলে তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়া কিংবা তাঁর পছন্দের কফি সম্পর্কে জেনে নেওয়ার ব্যপারটা ক্রেতাদের আরও বেশি স্টারবাকসে যেতে উৎসাহিত করতে শুরু করল। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ক্যাফেগুলোতে কফি কাপে কাস্টমারের নাম লেখা থাকে। কাস্টমারদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এই পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেছিল স্টারবাকস।

আর তখনই প্রশ্ন আসে, যখন এটা শুধু কফি, তখন একই কফি কম দামে অন্য জায়গা থেকে কেনা যাবে না কেন? এভাবেই স্টারবাকস তার লয়্যাল গ্রাহকদের হারাতে শুরু করে।

ব্যবসা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও স্টারবাকস ছিল আক্রমণাত্মক। শুল্টজ মূলত ‘অ্যাগ্রেসিভ এক্সপ্যানশন প্ল্যান’ অনুসরণ করেছিলেন। ফলে ১৯৯২ সালের মধ্যে স্টারবাকসের আউটলেটের সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ১৬৫ তে। ১৯৯৬ সালে এক হাজার আউটলেট হয়ে যায় স্টারবাকসের। এ সময় জাপান ও সিঙ্গাপুরেও তাদের নতুন আউটলেট খোলা হয়। আসলেই খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকে স্টারবাকস। ২০০০ সাল নাগাদ তাদের আউটেলেটের সংখ্যা হয়ে যায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি। এ সময় তাদের কার্যক্রম ১২টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

২০২৪ সালের স্টারবাকসের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বজুড়ে ৮০টিরও বেশি দেশে তাদের ৪০ হাজারের বেশি আউটলেট রয়েছে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই আছে প্রায় সতের হাজার চেইন শপ। বাৎসরিক ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের কফি বিক্রি করে স্টারবাকস। আর বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তাদের কর্মী সংখ্যা ৩ লাখ ৮১ হাজার।

স্টারবাকস মূলত তাদের কাস্টমার সার্ভিসে ‘কাস্টমার যেখানে, স্টারবাকস সেখানে’ পলিসিতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ যেসব দেশে তাদের কার্যক্রম আছে সেখানের ব্যস্ততম এলাকাতে আপনার আশেপাশে স্টারবাকসের আউটলেট থাকবেই। তাদের শপ লোকেশন এমনভাবে ঠিক করা হয় যাতে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে স্টারবাকসে অনেকেই একটু ঢুঁ মারতে পারে। আর এই লোকেশন ঠিক করতে তাদের রয়েছে দক্ষ টিম। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এত সফল ব্র্যান্ডের সমস্যার শুরু কোথা থেকে? চলুন বিশেষজ্ঞদের মতে উত্তর জানা যাক।

ব্র্যান্ড কনসেপ্ট থেকে সরে আসা

স্টারবাকসের মূল শক্তি ছিল তাদের ব্র্যান্ড কনসেপ্ট, অর্থাৎ ‘থার্ড স্পে’ তৈরি করা। এছাড়া তাদের মূলত কোনো সিক্রেট রেসিপি ছিলনা। তাদের মূল আকর্ষণ ছিল, এটা এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষ বাড়ির বাইরে এবং অফিসের বাইরে বসে সময় কাটাতে পারে। বাড়ি হলো প্রথম স্পেস, অফিস দ্বিতীয় স্পেস আর স্টারবাকস ছিল সেই তৃতীয় স্পেস।

জেরি বোল্ডউইন, গর্ডন বোকার এবং জেভ সিগল। সংগৃহীত ছবি
জেরি বোল্ডউইন, গর্ডন বোকার এবং জেভ সিগল। সংগৃহীত ছবি

স্টারবাকস ধীরে ধীরে এই ধারণা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তারা কেবল কফি বিক্রির দিকে মনোযোগ দেয়। দোকানের আকার ছোট হতে থাকে, বসার জায়গা কমে আসে। টেক অ্যাওয়ে বাড়ে। আর বড় ধাক্কা আসে যখন ড্রাইভ-থ্রু দোকানের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, যেখানে গ্রাহককে দোকানে ঢুকতেই হয় না; গাড়ি থেকে নামা ছাড়া জানালা দিয়েই কফি নিয়ে চলে যাওয়া যায়।

এরপর অনলাইন অর্ডার ডেলিভারি আর টেক অ্যাওয়ের মাধ্যেম স্টারবাকস ভেতরে বসার চাইতে বরং কাস্টমারদের কফি নিয়ে দ্রুত চলে যাওয়াতেই উৎসাহিত করা শুরু করল। দ্রুত লাভ বাড়াবার উপায় হিসেবে প্রথম প্রথম এই সিস্টেম কাজ করলেও সবাই স্টারবাকসে বসে সময় কাটানোর অভ্যাসটাই ভুলে যায়। তাঁদের কাছে স্টারবাকস আর থার্ড স্পেস নয়, হয়ে যায় শুধু এক মগ কফি নেওয়ার জায়গা।

আর তখনই প্রশ্ন আসে, যখন এটা শুধু কফি, তখন একই কফি কম দামে অন্য জায়গা থেকে কেনা যাবে না কেন? এভাবেই স্টারবাকস তার লয়্যাল গ্রাহকদের হারাতে শুরু করে।

বাড়াবাড়ি সহজলভ্যতা তৈরি করা

গত চার বছরে স্টারবাকস তার আউটলেটের সংখ্যা বাড়িয়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বাড়াবাড়ি ডিস্ট্রিবিউশন এক্সপানসনে যে সহজলভ্যতা তৈরি হয়েছে তাতে কাস্টমারদের কাছে স্টাররবাকসের এক্সক্লুসিভনেসটা নষ্ট হতে শুরু করেছে।’

কর্মীদের খেয়াল না রাখা

ট্রিলিয়ন ডলার কোচ বিল ক্যাম্পবেলের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার এমপ্লয়িদের খেয়াল রাখো, তারা বাকিদের যত্ন নেবে।’ আর এখানেই ভুলটি করেছে স্টারবাকস। গত চার বছরে স্টারবাকসের আউটলেটের সংখ্যা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ, একই সময়ে এর কর্মীসংখ্যা কমেছে। এ থেকে বোঝা যায় কর্মীদের উপর চাপও তৈরী হয়েছে।

ব্যবসা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও স্টারবাকস ছিল আক্রমণাত্মক। শুল্টজ মূলত ‘অ্যাগ্রেসিভ এক্সপ্যানশন প্ল্যান’ অনুসরণ করেছিলেন। ফলে ১৯৯২ সালের মধ্যে স্টারবাকসের আউটলেটের সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ১৬৫ তে।

ফলে কর্মীদের কাজে আসতে অনীহা, কাজ ছেড়ে চলে যাওয়া, খারাপ সার্ভিস কোয়ালিটি, কাস্টমারদের লম্বা লাইন, কর্মীদের সঙ্গে কাস্টমারদের বাদানুবাদ ইত্যাদি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে! এমনকি স্টারবাকসের কর্মীরা এখন ওয়ার্কার ইউনিয়ন তৈরি করে কর্মবিরতি থেকে শুরু করে নানা কারণে কর্তৃপক্ষকে একের পর এক মামলার মুখোমুখি করছে। এতে করে স্টারবাকসের কাস্টমার লয়্যালিটি, ব্র্যান্ড ভ্যালু আর সার্ভিস কোয়ালিটি নষ্ট হচ্ছে।

জানা যায় গত এক বছরেই স্টারবাকস তার মার্কেট ভ্যালু হারিয়েছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। রেভিনিউ গ্রোথ নেই বললেই চলে। বিভিন্ন দেশে অনেক আউটলেট বন্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি এই আইকনিক প্রতিষ্ঠানটি চীনে অপারেশন কন্ট্রোলের জন্য চীনের শীর্ষ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বয়ু ক্যাপিটাল-এর সঙ্গে যৌথভাবে কফি শপ পরিচালনার নতুন এক চুক্তি করেছে।

স্টারবাকস জানিয়েছে, নতুন চুক্তি অনুযায়ী চীনে তাদের ব্যবসার ৬০ শতাংশ পরিচালনা করবে বয়ু ক্যাপিটাল। বাকি ৪০ শতাংশ থাকবে স্টারবাকসের তত্ত্বাবধানে। এ চুক্তির মোট মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। তবে ব্র্যান্ডের মালিকানা স্টারবাকসের কাছেই থাকবে। চুক্তিটি আগামী বছর কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে বলা যায় স্টারবাকস এখন কঠিন সময়ের মধ্যে আছে। স্টারবাকসের সিইও পরিবর্তন করে নতুন সিইও আনা হয়েছে। নতুন সিইও ঘোষণার পর কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বেড়েছিল ২০ শতাংশ। আউটলেটের সংখ্যা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ১০০ করপোরেট কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে তারা। ওয়ার্কার ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চলছে। এই পরিস্থিতি থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই কফি-শপ কি আবার ফিরে আসতে পারবে কফির চমৎকার ঘ্রান নিয়ে? তা আসলে সময়ই বলে দেবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত