leadT1ad

শিশু-কিশোরদের মনে দুর্ঘটনা ও সহিংসতার প্রভাব প্রতিরোধে কী করবেন

আমাদের চারপাশে অনেক দুর্ঘটনা ও সহিংসতা শিশু-কিশোরদের মনের ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। শিশু-কিশোরেরা কখনো সরাসরি ঘটনার শিকার হচ্ছে। কখনো নিজের চোখের সামনে ঘটনাগুলোকে ঘটতে দেখছে। এমনকি আশপাশের মানুষের মাধ্যমে অপ্রত্যাশিতভাবে জেনে যাচ্ছে সহিংসতার খবর।

সাঈদুস সাকালানঢাকা
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৫১
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ২০: ২৪
প্রতীকী ছবি। ফ্রিপিক থেকে নেওয়া

শিশু-কিশোর বলতে আমরা শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বুঝে থাকি। এ সময়ে তারা যা দেখে, শোনে ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সেটিই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় অন্তত চারটি বিষয়— আবেগ, অনুভূতি, স্মৃতি ও চিন্তা। মানুষের আচরণ, কথাবার্তা আর ব্যক্তিত্ব গঠনে এগুলোর সমন্বিত প্রকাশ ঘটে থাকে।

গত একবছর ধরে আমাদের চারপাশে অনেক দুর্ঘটনা ও সহিংসতা ঘটেছে। বিশেষত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শিশু-কিশোরেরা যে সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে, তা অবর্ণনীয়।

এরপর ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হলো। মারা গেলো অনেক শিশু। যে শিশুটি একদিন আগেও ক্লাসে এসেছিল, পরদিন অন্য শিশুরা পেলো তাঁর মরদেহ। জুলাই-আন্দোলনের সময়েও এমন ঘটেছে। বিগত সরকারের নৃশংসতায় শিশুরা হারিয়েছে তার সহপাঠীকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব ঘটনা শিশু-কিশোরদের মনের ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। শিশু-কিশোরেরা কখনো সরাসরি ঘটনার শিকার হচ্ছে। কখনো নিজের চোখের সামনে ঘটনাগুলোকে ঘটতে দেখছে। এমনকি আশপাশের মানুষের মাধ্যমে অপ্রত্যাশিতভাবে জেনে যাচ্ছে সহিংসতার খবর।

এছাড়া ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও মোবাইলে বিভিন্ন খবর, ছবি আর ভিডিও দেখার মাধ্যমে শিশু-কিশোরেরা এখন প্রায়ই দুর্ঘটনা ও সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে।

শিশুমনে যেসব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে

শিশু-কিশোরদের মনে দুর্ঘটনা ও সহিংসতা নানাভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে ভয় পেতে পারে, আতঙ্কিত হতে পারে। কারো কারো ঘুম কমে যেতে পারে। অনেক সময় শিশু-কিশোরেরা কান্নাকাটি করতে পারে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। দেখা দিতে পারে নানা রকম অস্বাভাবিক আচরণ।

এ সময় পড়ালেখায় শিশু-কিশোরদের মনোযোগ কমে যাওয়াও স্বাভাবিক। আর গভীর মানসিক চাপ দীর্ঘায়িত হলে ট্রমার ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে কিছু তীব্র মানসিক চাপ দেখা যায়। যেমন অ্যাকিউট স্ট্রেস, কনভার্সন ডিজঅর্ডার (মানসিক অস্থিরতা থেকে শারীরিক লক্ষণ), ব্রিফ সাইকোসিস বা সাময়িক উন্মাদনা, প্যানিক অ্যাটাক বা আতংক, অ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা, অ্যাডজাস্টমেন্ট সমস্যা, বিরূপ আচরণজনিত সমস্যা বা কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার ইত্যাদি।

এখানেই শেষ নয়, ট্রমার কারণে শিশুদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শোকার্ত ভাব বা প্যাথলজিক্যাল গ্রিফও পরিলক্ষিত হতে পারে। এছাড়া চার সপ্তাহ পর থেকে কয়েক মাসের মধ্যে দেখা দিতে পারে আঘাত-পরবর্তী মানসিক চাপ বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, যা তার মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে বিষন্নতা ও সামাজিক ভীতি।

এসব সমস্যায় কী হয়

এসব সমস্যা দেখা দিলে শিশু-কিশোরের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও একাডেমিক বলয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এই ট্রমার অভিজ্ঞতা দীর্ঘমেয়াদে অস্বাভাবিকভাবে থেকে গিয়ে তাদের ব্যক্তিত্বের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন কারও ওপর তারা নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে, লোকজন এড়িয়ে চলতে পারে এবং তার মধ্যে দেখা দিতে পারে সন্দেহপ্রবণতা।

প্রকৃতপক্ষে ট্রমা শিশু-কিশোরদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিতে সক্ষম। এক্ষেত্রে যারা সরাসরি ঘটনার শিকার শুধু তারাই নয়, বরং যারা এসব ঘটনা দেখেছে বা শুনেছে, তারাও থাকে তীব্র ঝুঁকিতে। তাই যেসব শিশু-কিশোর এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, তাদের প্রতি শুরু থেকেই যত্নশীল হওয়া জরুরি।

আমাদের যা করণীয়

১. শিশুদের সামনে দুর্ঘটনার ছবি ও ভিডিও দেখা এবং এ বিষয়ে আলোচনা করাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এখানে শিশুর পরিবার ও প্রতিবেশীকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। বারবার দুর্ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করা ও আলোচনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ গণমাধ্যমকেও এ ব্যাপারে সংবেদনশীল হতে হবে। উদ্ধার কাজে সহায়ক হয়, এমন ভিডিও ছাড়া অন্য ছবি বা ভিডিও প্রচার না করাই শ্রেয়।

২. প্রথম দিকে কিছুদিন শিশুদের রুটিন এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। যেমন: ঘুম কমে যাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ইত্যাদি। এক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে শিশুর ঘুম ও খাওয়া যেন ঠিক থাকে। তবে এগুলো নিয়ে একদমই জোরাজুরি করা যাবে না। কিন্তু শিশুর আচরণ যদি বেশি অস্বাভাবিক হয়—যেমন সহিংস আচরণ করা, বিনা কারণে হাসা-কাঁদা, আপনজনকে চিনতে না পারা, কথা বলতে না পারা, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট বা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া—এসব দেখা দিলে দ্রুত একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

৩. এই ধরনের দুর্ঘটনার পর প্রথম কাজ হলো বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। সে যেন সহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ সময় শিশুর সঙ্গে সময় কাটানো, খেলাধুলা ও গল্প করা খুব ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। শিশুকে সাহস দেওয়া এবং তার পছন্দের কাজ করাও তাকে চাপ মুক্ত রাখতে সহায়তা করে। তবে অবশ্যই দুর্ঘটনার আলোচনা এড়িয়ে চলতে হবে।

৪. পড়ালেখা কিংবা স্কুলে যাওয়া নিয়ে শিশুকে কোনোরকম চাপাচাপি করা যাবে না। কারণ, স্কুলই তার ভয়ের কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।

৫. শিশুকে তার সমবয়সীদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দিতে হবে। আহত বা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত শিশুকে দেখে আপনার শিশুটি যেন আরও অসুস্থ হয়ে না পড়ে। যদি এমনটি ঘটতে পারে বলে মনে করেন, তবে আহত বা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে যোগাযোগ না করাই ভালো।

৬. অনেক স্কুল বা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর থাকেন। এ অবস্থায় তাঁদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত।

Ad 300x250

সম্পর্কিত