leadT1ad

যে জীবন ওজি অসবোর্নের: বিদায় হেভি মেটালের ‘গডফাদার’

রকসংগীতের ইতিহাসে এক অসামান্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। গতকাল রাতে ৭৬ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছেন হেভি মেটালের ‘গডফাদার’ ব্ল্যাক সাবাথ ব্যান্ডের ওজি অসবোর্ন। আমরা ফিরে তাকাচ্ছি তাঁর গোটা সংগীতজীবনের দিকে।

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ২০: ৩৫
যে জীবন ওজি অসবোর্নের: বিদায় হেভি মেটালের ‘গডফাদার’। স্ট্রিম গ্রাফিক

ওজি অসবোর্ন। যাঁকে আমরা চিনি হেভি মেটাল মিউজিকের ‘গডফাদার’ হিসেবে। কিন্তু ওজির শুরুটা ছিল অনেক সাধারণ, অনেক কষ্টের। আসল নাম জন মাইকেল অসবোর্ন। জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩ ডিসেম্বর, ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের অ্যাস্টনে।

ওজির ছোটবেলা ছিল দারিদ্র্যঘেরা। মনোযোগ ধরে রাখতে না পারার রোগ ‘এডিএইচডি’-এর কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতেন না। এ জন্য সবাই তাঁকে ‘ওজব্রেইন’ বলে ডাকত। সেখান থেকেই আসে ‘ওজি’ নামটা।

তবে ওজি অসবোর্নের আগ্রহ ছিল গান আর নাটকে। স্কুলের নাটকে অভিনয় করতেন। এরপর ১৫ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন। কসাইখানায় সহকারী থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার শ্রমিক—শুরু হয় অদ্ভুত সব চাকরির পালা। জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। টাকার অভাবে চুরির পথ বেছে নেন। সেই অপরাধে কিশোর বয়সে ছয় সপ্তাহের জন্য জেলও খাটেন।

তখন কি কেউ ভেবেছে, সবাই যাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে সেই ছেলেই একদিন হয়ে উঠবে সংগীতপ্রেমিদের প্রিয় ‘প্রিন্স অব ডার্কনেস’!

যেভাবে গানে, ওজি অসবোর্ন আর ব্ল্যাক সাবাথের শুরুর কাহিনি

ওজি অসবোর্নের গানের জগতে আসার কাহিনি ঠিক যেন সিনেমার মতো। একদিকে অভাব, হতাশা আর অন্ধকার; অন্যদিকে ছিল স্বপ্ন আর সাহস।

এখানে বড় ভূমিকা রাখে ট্রানজিস্টার রেডিও। ছোটবেলায় একদিন রেডিওতে শুনলেন দ্য বিটলসের গান ‘শি লাভস ইউ’। গানটা যেন তাঁর জীবনে আলোর ঝলক নিয়ে এল। পরে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘সেই মুহূর্তটা আমার জীবনে আনন্দ আর আশার এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।’

তখন থেকেই মনে মনে ঠিক করলেন, তিনিও গান গাইবেন। কোথায় কী করতে হবে, কিছুই জানতেন না। কিন্তু ইচ্ছেটা ছিল তীব্র। তাই স্থানীয় এক মিউজিক শপের জানালায় লিখে রাখলেন ‘ওজি গান গাওয়ার একটা সুযোগ চায়।’

এই তীব্র ইচ্ছা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু গিজার বাটলারের হাত ধরে ওজি যুক্ত হলেন ‘রেয়ার ব্রিড’ নামে একটা ব্যান্ডে। যদিও ব্যান্ডটা মাত্র দুইটা শো করার পর ভেঙে যায়। পরে তাঁরা ‘পোলকা টাল্ক ব্লুজ ব্যান্ড’ নামে একটা ব্যান্ড গড়েন। কিছুদিন পর ব্যান্ডের নাম পালটে রাখা হয় ‘আর্থ’।

কোনো কনসার্টে আমন্ত্রিত না হলেও আর্থের সদস্যরা হাজির হয়ে যেতেন। যদি আমন্ত্রিত কোনো ব্যান্ড যদি সেই কনসার্টে না আসে, তাহলে তাঁরা সেই সুযোগে গান গাইবেন! একদিন তাঁরা একটি সিনেমা হলের উল্টো দিকের ঘরে প্র্যাকটিস করছিলেন। তখন সেই হলে চলছিল হরর ফিল্ম ‘ব্ল্যাক সাবাথ’। এই নামটা তাঁদের মনে দাগ কাটে। হঠাৎ ব্যান্ডের নতুন নামও হয়ে যায় ব্ল্যাক সাবাথ। তাঁরা চেয়েছিলেন, এমন গান বানাবেন তা যেন ঠিক হরর ফিল্মের সাউন্ডট্র্যাকের মতো মনে হয়।

ব্ল্যাক সাবাথের প্রথম লাইন-আপ। ছবি: সংগৃহীত
ব্ল্যাক সাবাথের প্রথম লাইন-আপ। ছবি: সংগৃহীত

ব্ল্যাক সাবাথ সেভাবেই গান করা শুরু করল। এরপর ব্ল্যাক সাবাথসহ কয়েকটি ব্যান্ড মিলে তৈরি করলেন হেভি মেটাল মিউজিকের সাউন্ডস্কেপ। নতুন এই জনরা মূলত রক মিউজিকের একটি শাখা। সারা বিশ্বে তৈরি হলো নতুন ‘ক্রেজ’। দিনে দিনে ব্ল্যাক সাবাথ আর ওজি হয়ে উঠলেন হেভি মেটাল মিউজিকের ‘পোস্টার ব্যান্ড’।

হেভি মেটালের জন্ম: ওজির ব্ল্যাক সাবাথ অধ্যায়

অনেকে মনে করেন, হেভি মেটাল শুরুই হয়েছিল ব্ল্যাক সাবাথকে দিয়ে। সংগীত ইতিহাস গবেষকদেরও মত এটাই। এসবের শুরু হয় ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে। মাত্র দুই দিনে খুব অল্প বাজেটে তারা রেকর্ড করে নিজেদের প্রথম অ্যালবাম। পরের বছর সেটি বাজারে আসে। ‘সেলফ টাইটেলড’ অ্যালবাম, নাম ‘ব্ল্যাক সাবাথ’। মজার ব্যাপার, অ্যালবামের প্রথম গানটার নামও ব্ল্যাক সাবাথ। সেই গানে শোনা যায় অদ্ভুত শব্দ, অসাধারণ গিটার রিফ আর একেবারেই অন্য রকম সুর। তখনকার দিনে এমন কিছু আগে কেউ শোনেনি।

এই অ্যালবাম দিয়ে তরুণদের মনে ঝড় তোলে ব্ল্যাক সাবাথ। যুক্তরাজ্যের মিউজিক চার্টে উঠে যায় সোজা আট নম্বরে। ছয় মাস পরেই আসে তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘প্যারানয়েড’। শিরোনাম গান ‘প্যারানয়েড’ এতটাই হিট হয় যে তারা জায়গা পায় জনপ্রিয় টিভি শো ‘টপ অফ দ্য পপস’-এ। এরপর অ্যালবামটি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশেও প্রকাশ পায়। আর ব্যান্ডটির গান ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।

কনসার্টে ওজি অসবোর্ন। সংগৃহীত ছবি
কনসার্টে ওজি অসবোর্ন। সংগৃহীত ছবি

তবে খুব দ্রুতই ব্যান্ডের খারাপ সময় আসে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় তাদের অষ্টম অ্যালবাম ‘নেভার সে ডাই’। তখন ওজি অসবোর্নের অবস্থা একদম ভালো না। শরীর খারাপ, মনও ভেঙে পড়েছে। নিজেই ভর্তি হন হাসপাতালে।

এক বছর পর ব্যান্ডের সদস্যরা নিরূপায় হয়ে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেয়, ওজিকে বাদ দিতে হবে।

ওজি পরে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই তখন নেশায় ডুবে ছিলাম, কিন্তু আমি হয়তো একটু বেশিই ডুবে গিয়েছিলাম।’ ওজির সঙ্গে ব্ল্যাক সাবাথের এই সময়টা ছিল হেভি মেটালের প্রথম সোনালি দশক।

ব্লিজার্ড অব ওজ, ওজফেস্ট আর নতুন পরিচয়

ব্ল্যাক সাবাথ থেকে বাদ পড়ে ওজি অসবোর্ন ভেঙে পড়েছিলেন। তিন মাস মদ আর কোকেনে ডুবে ছিলেন। ঠিক তখনই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যান্ড ম্যানেজার ডন আরডেন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যান। তিনি ওজিকে নতুন গানের জন্য একটি রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করিয়ে দেন। আর নিজের মেয়ে শ্যারনকে পাঠান ওজির পাশে থাকতে। শ্যারনের সঙ্গেই পরে ওজির প্রেম হয়, বিয়ে হয়।

১৯৭৯ সালে ওজি নিজের একক ক্যারিয়ার শুরু করেন ‘ব্লিজার্ড অব ওজ’ অ্যালবাম দিয়ে। পাশে পেয়েছিলেন অসাধারণ গিটারিস্ট র‍্যান্ডি রোডসকে। দুই বছরে বাজারে আসে তাঁর দুটি অ্যালবাম। ‘ক্রেজি ট্রেন’ আর ‘মিস্টার ক্রাউলি’ গান দিয়ে তিনি দেখিয়ে দেন, ওজি একাই যথেষ্ট।

কনসার্টের বাইরে ওজি অসবোর্ন। সংগৃহীত ছবি
কনসার্টের বাইরে ওজি অসবোর্ন। সংগৃহীত ছবি

তবে ওজির জীবন ছিল বিতর্কে ভরা। এক কনসার্টে ভুল করে বাদুড়ের মাথা কামড়ে ফেলেন, এরপর হাসপাতালে যেতে হয়। একই বছরে টেক্সাসে একটি স্মৃতিস্তম্ভে প্রস্রাব করার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। এর কিছুদিন পরই দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁর গিটারিস্ট র‍্যান্ডি রোডস। ওজির জন্য এটি ছিল এক বিশাল ধাক্কা।

তবুও ওজি থেমে যাননি। একের পর এক সফল অ্যালবাম দিয়েছেন। ১৯৯১ সালে ‘নো মোর টিয়ার্স’ অ্যালবামের ‘মামা, আইম কামিং হোম’ গানটি হিট হয়। এরপর শুরু করেন নিজের মিউজিক ফেস্টিভ্যাল ‘ওজফেস্ট’। সেখানে অনেক বিখ্যাত ব্যান্ড অংশ নেয়। ২০০৪ সালে এমটিভিতে শুরু হয় ‘ব্যাটেল ফর ওজফেস্ট’ নামের রিয়েলিটি শো।

এরপর এমটিভিতে ‘দ্য ওসবর্নস’ রিয়েলিটি শো পায় তুমুল জনপ্রিয়তা। বিরতির পর আবার ২০১৬ সালে ‘ওজি অ্যান্ড জ্যাক্স ওয়ার্ল্ড ডি ট্যুর’ নামে আরেকটি রিয়েলিটি শো শুরু করেন ওজি। এভাবেই রিয়েলিটি শোর দুনিয়ায় ওজি হয়ে উঠেছিলেন এক বিখ্যাত নাম।

১৯৮০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ওজি করেছেন ১৩টি একক অ্যালবাম। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ব্ল্যাক সাবাথের সঙ্গে ফের একত্র হয়ে করেছেন ‘থারটিন’ নামের একটি অ্যালবামটি। তাঁর সলো ক্যারিয়ার যেমন বড়, তেমনি ছিল নানা কনসার্ট ট্যুরে ভরা এক পাগলাটে জীবনের গল্প।

ব্যাক টু দ্য বিগিনিং: ওজি’জ ফাইনাল বাউ—ভিলা পার্কের সেই রাত

যেই শহরে ব্ল্যাক সাবাথের হেভি মেটাল অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল, তিন সপ্তাহ আগে সেখানেই জীবনের শেষ কনসার্টে গান করেন ‘প্রিন্স অব ডার্কনেস’ ওজি অসবোর্ন। দিনটি ছিল ২০২৫ সালের ৫ জুলাই। এমন স্মরণীয় ফেয়ারওয়েল কনসার্ট আগে দেখা যায়নি। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের ভিলা পার্ক স্টেডিয়ামের মঞ্চে ওজির সঙ্গে ছিলেন ব্ল্যাক সাবাথের তিন মূল সদস্য—টনি আইওমি, গিজার বাটলার আর বিল ওয়ার্ড।

ব্যাক টু দ্য বিগিনিং: ওজি’জ ফাইনাল বাউ কনসার্টে। সংগৃহীত ছবি
ব্যাক টু দ্য বিগিনিং: ওজি’জ ফাইনাল বাউ কনসার্টে। সংগৃহীত ছবি

অনেক বছর পর তাঁরা একসঙ্গে গাইলেন ‘আইরন ম্যান’, ‘ওয়ার পিগস’, ‘পারানয়েড’-এর মতো কালজয়ী গান। ওজির জন্য তৈরি করা হয়েছিল বাদুড়-থিমের একটি সিংহাসন। সেখানেই বসে তিনি গাইলেন শেষবারের মতো। সেদিন স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল ওজির পুরোনো দিনের ভিডিও। আর হাজার হাজার দর্শক একসঙ্গে গাইছিলেন তাঁর গান।

এই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় মঞ্চে ছিলেন রক দুনিয়ার আরও অনেক তারকা। মেটালিকা, আইরন মেইডেন, নির্ভানা, জুডাস প্রিস্ট আর স্লিপনট ব্যান্ডের কিংবদন্তিরা সেদিন গান আর গল্পে জানিয়েছিলেন এই পথিকৃতের প্রতি ভালোবাসা। গান থেকে ওজির বিদায়ের সেই রাতটি যেন হয়ে উঠেছিল রক মিউজিকের এক অসাধারণ অধ্যায়।

ওজি অসবোর্নের জীবন ও গান আমাদের শেখায়, কঠিন সময়েও স্বপ্ন আর সুরকে ধরে রাখতে হয়। সত্যিকারের শিল্পী কখনো হার মানেন না। আমরা তাঁর গান আর জীবনকে ভালোবাসা দিয়ে আজীবন স্মরণ করব। কারণ, তিনি সংগীত দুনিয়ায় এনেছিলেন নতুন এক জনরা—হেভি মেটাল মিউজিক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত