leadT1ad

কুষ্টিয়ার জগতি রেলস্টেশন: বাংলাদেশে রেলের যাত্রা শুরু যেখানে

আমরা কি জানি, ১৬৩ বছর আগে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলের যাত্রা শুরু হয়? কেমন ছিল যাত্রা শুরুর সেই গল্প? আর কেন-ই বা সেখানে প্রথম রেলস্টেশন চালু হয়েছিল? বর্তমানে এই স্টেশনের কী হালচাল, বিস্তারিত লিখেছেন তামান্না আনজুম

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৫৯
জগতি রেলস্টেশন । ছবি: গৌতম কে শুভ

দুনিয়ায় রেলের ইতিহাস শুরু হয়েছিল বহু আগেই, ১৮২৫ সালে। ইংল্যান্ডের এক প্রকৌশলী জর্জ স্টিফেনসন ‘লোকোমোশন’ নামে প্রথম স্টিম ইঞ্জিনচালিত ট্রেন বানিয়েছিলেন। ছোট্ট ২৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্টকটন থেকে ডালিংটন পর্যন্ত ছুটেছিল সেই ট্রেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে রেলগাড়ি।

সেই সময় ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের অধীন। ব্যবসা, শাসন ও পণ্যের চলাচল সহজ করতে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় উপমহাদেশে রেললাইন বসানোর। ১৮৫৩ সালে মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে থানে পর্যন্ত চালু হয় প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন। এক বছর পর রেল চলাচল শুরু হয় বাংলা অঞ্চলেও। পশ্চিমবাংলার হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ছিল সেই রেলপথ।

তারপর ১৮৬২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে চালু করে শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেললাইন। সেটি বাড়িয়ে আনা হয় আজকের কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর, ঐতিহাসিক সেই দিনে আজকের বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পড়ে প্রথম রেলগাড়ি। কলকাতার শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা ট্রেনের গন্তব্য ছিল কুষ্টিয়ার ‘জগতি রেলস্টেশন’। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তৎকালীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলের যাত্রা। যা পরে যোগাযোগব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল।

জগতি রেলস্টেশন । ছবি: গৌতম কে শুভ
জগতি রেলস্টেশন । ছবি: গৌতম কে শুভ

এরও প্রায় ১০ বছর পর, ১৮৭১ সালে জগতি থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নতুন রেললাইন চালু হয়। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার সহজতম এই পথে রেলপথ সংযোগ চালু করা ছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তখন শিয়ালদহ থেকে ট্রেন আসত জগতি পেরিয়ে গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে। এরপর স্টিমারে পদ্মা পার হয়ে যাত্রীরা সহজেই চলে আসতেন ঢাকায়।

সেই সময়ে রেলের ইঞ্জিন চলত কয়লা পুড়িয়ে। ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে হুইসেল দিতে দিতে ট্রেন ঢুকত স্টেশনে। ব্রিটিশরা জগতিতে তৈরি করেছিল লাল ইটের দোতলা স্টেশন ভবন, ওয়েটিং রুম, পানির ট্যাংক, টিকিট ঘর, সিগন্যাল ল্যাম্প। কিন্তু আজ?

এই সময়ের জগতি

এখন জগতি স্টেশন যেন পড়ে আছে ইতিহাসের খাতার বাতিল পৃষ্ঠা হয়ে। চারপাশে নিঃশব্দ, প্লাটফর্ম ভাঙা, ভবনে ফাটল। আর আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ভগ্নপ্রায় সেই স্টেশন ভবনে। কুলির হাঁকডাকও নেই। নেই ট্রেনের হুইসেল। রাত নামলেই যেন এক ভুতুড়ে জায়গা।

শুধু দুটি লোকাল ট্রেন থামে জগতি স্টেশনে। খুব অল্প যাত্রী ওঠানামা করেন। স্টেশনে ছাউনিও নেই। অপেক্ষারত যাত্রীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকাল ট্রেন আসার সময় গোনেন। এখন মাঝেমধ্যে মালবাহী ট্রেনও আসে। স্টেশনে কর্মচারী মাত্র কয়েকজন। স্টেশনের পাশেই গড়ে উঠছে ছোট গ্রামীণ বাজার। ফলে মানুষের আনাগোনা এখন কিছুটা বেড়েছে।

জগতি রেলস্টেশন । ছবি: গৌতম কে শুভ
জগতি রেলস্টেশন । ছবি: গৌতম কে শুভ

কেন জগতিতে

প্রথম রেলস্টেশন কেন জগতিতেই? সেই রহস্য লুকিয়ে আছে ব্রিটিশ আমলের হিসাব-নিকাশে। পুরো ভারতবর্ষকে ব্যবসা ও শাসনের সুবিধার্থে জালের মতো রেললাইন দিয়ে জুড়েছিল ব্রিটিশরা। তখন তারা খুঁজছিল এমন এমন জায়গা, যেখানে নতুন রেললাইন বসালে বছর শেষে তাদের লাভের অঙ্ক বাড়বে।

জগতির কাছাকাছি ছিল কলকাতা–রানাঘাট রেলপথ। তাই সেখানে নতুন বড় কোনো প্রকল্প ছাড়াই বর্ধিত অংশ হিসেবে কম খরচে জগতি পর্যন্ত রেলপথ আনা যায়। এই বুদ্ধিই তারা কাজে লাগিয়েছিল।

তবে শুধু ভৌগলিক কারণেই নয়। বাণিজ্যের দিক থেকেও সেই সময়ের কুষ্টিয়া অঞ্চল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মার আশপাশে ছিল ধান, পাট, গম, আখের জমি। এখান থেকে পণ্য কলকাতা বা ঢাকায় পাঠানো ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রধান লক্ষ্য।

এই রেলপথের সুফল হিসেবে ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়ায় গড়ে ওঠে তখনকার এশিয়ার সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল মিল—মোহিনী মিল। ট্রেন ছাড়া এত বড় মিলের কাঁচামাল আনা বা পণ্য পাঠানো সম্ভবই হতো না। পাকিস্তান আমলেও কুষ্টিয়ায় তৈরি হয় চিনিকল। যেখানে আখ পৌঁছাত এই রেলপথ দিয়েই।

Ad 300x250

সম্পর্কিত