leadT1ad

কান চলচ্চিত্র পুরস্কার

কী আছে আদনানের ‘আলী’তে, কেন পেলেন কানের স্বীকৃতি

সদ্য সমাপ্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথমবারের মতো বিশেষ স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আলী’। এ ছবির নির্মাতা আদনান আল রাজীব কীভাবে গেলেন এত দূর? লিখেছেন তুফায়েল আহমদ

বাংলা স্ট্রিম
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৫, ২৩: ৫২
আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ১৩: ৩৪

হলভর্তি দর্শকদের মধ্যে কান চলচ্চিত্র উৎসবের রঙিন মঞ্চে জার্মান পরিচালক মারেন আদে যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র 'আলী'র বিশেষ স্বীকৃতির (স্পেশাল মেনশন) ঘোষণা দিলেন, হয়তো সেই মুহূর্তে আদনান আল রাজীবের জন্য সময় খানিকটা থেমে গিয়েছিল।

চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রার প্রতিটি দৃশ্য—আলোকছায়ার খেলা, প্রথম দৃশ্যধারণ, অনিশ্চয়তা, ভালোবাসা, নির্ঘুম রাত আর অন্তহীন স্বপ্ন। তারপরই হলজুড়ে বাজল মুহুর্মুহু করতালি! ক্যামেরা ধীরে ধীরে ঘুরে গেল তাঁর দিকে—চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে সংযত এক হাসি। তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। চোখের কোণে অশ্রু, হৃদয়ে এক গর্বিত ধ্বনি—বাংলাদেশ। পুরস্কার পাওয়ার পর প্রথম সুযোগেই ফেসবুকে পোস্ট করে বললেন, ‘এই জয় বাংলাদেশের জন্য।’

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে ‘আলী’ পেলো কান উৎসবের স্বীকৃতি। ৭৮তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে ‘আলী’।

এই স্বীকৃতি শুধু একটি চলচ্চিত্র বা একজন নির্মাতার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রচর্চার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বলে মনে করছেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। যে দেশে সিনেমার জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা করে নেওয়া এখনো অনেকটাই সংগ্রামের বিষয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ‘আলী’র এই স্বীকৃতি এক নতুন সম্ভাবনার জানালা খুলে দিল বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন সিনেমাপ্রেমীরা।

আদনান আল রাজিবের ঘর-বাহির

‘আলী’র পেছনের কারিগর আদনান আল রাজীব পর্দায় বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যান অবলীলায়, জটিলতাকে বলেন সহজ করে। বাংলাদেশি দর্শকদের কাছে আদনান প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন ২০১৩ সালের এয়ারটেল প্রেজেন্টস ‘অ্যাট এইট্টিন: অল টাইম দৌড়ের ওপর’ নাটকের মাধ্যমে। তবে আদনানের সিনেমার সঙ্গে সম্পর্কের গল্পটা তারও আগের। পরিচালক হিসেবে নিজের যাত্রা শুরু করার আগে আদনান পাঁচ বছর মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবিয়ালে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।

পাঁচ বছর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর ২০০৯ সালে আদনান নিজে পরিচালনা শুরু করেন। তাঁর প্রথম নাটক ‘উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞান’। মুক্তির পরপরই নাটকটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। আদনান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নাটকটির বিপুল সাড়া তাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার।’

এর পর থেকে আদনান নিয়মিতভাবে নাটক ও বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে গেছেন। ২০০৯ সালে তিনি ‘লাকি থার্টিন’ এবং ‘পার্শ্ববর্তী প্রেম নিবেদন’ নাটক দুটি পরিচালনা করেন। ২০১৩ সালে ‘অ্যাট এইট্টিন: অল টাইম দৌড়ের ওপর’ নাটকটির তাঁকে এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি। এরপর ২০১৪ সালে ‘মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট’, ২০১৭ সালে ‘বিকাল বেলার পাখি’ নির্মাণ করেন। ২০২১ সালে আদনান অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’র জন্য ‘ইউটিউমার’ ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করেন।

নাটকের গল্প

আদনান তাঁর নাটকগুলোতে প্রধানত মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রা, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন বারবার। সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তবতা এবং তাদের অনুভূতিগুলোকে কেন্দ্র করেই তাঁর কাজগুলো নির্মিত বলে দর্শকদের সঙ্গে সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন। ‘বিকাল বেলার পাখি’ নাটকে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সংকট এবং বাবা-ছেলের সম্পর্কের জটিলতা তুলে ধরেছেন খুব সহজ ক্যানভাসে। আদনানের সহজ গল্প বলার মুনশিয়ানার কারণে নাটকটি পেয়েছিল ভীষণ দর্শকপ্রিয়তা।

আদনানের নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—হাস্যরসের আড়ালে তিনি সমাজের গভীর বাস্তবতাকে তুলে ধরেন। ‘অ্যাট এইটটিন: অল টাইম দৌড়ের ওপর’ নাটকে তরুণ প্রজন্মের অনলাইন আসক্তি, এলোমেলো জীবনধারা এবং দিশাহীনতা যেমন মজার মোড়কে সমালোচনা করেছেন, ঠিক তেমনি নাটকের আরেক প্রান্তে উঠে এসেছে বয়স্ক মানুষদের নিঃসঙ্গতা এবং সমাজে প্রবীণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংকটের কথাও।

‘আলি’র পোস্টার
‘আলি’র পোস্টার

‘আলী’ ও এখনকার বাস্তবতা

আদনানের সর্বশেষ কাজ ‘আলী’-তেও উঠে এসেছে এখানকার বাস্তবতার আরেক অমোঘ সত্যের গল্প। কান উৎসবের অফিশিয়াল সাইটের ভাষ্যমতে, ‘আলী’র গল্প গড়ে উঠেছে উপকূলীয় একটি শহরকে কেন্দ্র করে, যেখানে নারীদের গান গাইতে দেওয়া হয় না। তবে এক কিশোর গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে উপকূল ছেড়ে শহরে যেতে চায়। আর তাঁর এই গান গাওয়া নিয়েই রয়েছে এক রহস্য।

নাটক থেকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে পা রাখলেও আদনান এখনো নিজের সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার চেষ্টায় নিবিষ্ট। 'আলী’র গল্প যেন সেই প্রচেষ্টারই এক নতুন রূপ। নাটক হোক কিংবা বিজ্ঞাপন, আদনান সব সময় মানুষ, সম্পর্ক, মনস্তত্ত্ব, আর নিজের সময়ের গল্পই বলে গেছেন বারবার। তাঁর নির্মাণে থাকে সংবেদন; চিত্রভাষায় থাকে কাব্যিক ছোঁয়া—যার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ‘আলী’।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়ে দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও আদনানের মেধার পূর্ণ প্রতিচ্ছবি এখনও অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে, এমনটাই মনে করেন তাঁর ভক্তরা। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আদনান পরিচালিত একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু এই অপেক্ষার অবসান কবে হবে, সে বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশাই রেখেছেন আদনান ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত