leadT1ad

জনশক্তি রপ্তানি কমলেও বাড়ছে প্রবাসী আয়

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে অর্থ পাচারের কারণে প্রবাসীদের আয় সম্পূর্ণভাবে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হতো না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থের পাচার কমে গেছে।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৪৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি কমছে। তবে বাড়ছে প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স। আর এতেই দীর্ঘদিন ধরে চলা ডলার সংকট অনেকাংশে কেটে গেছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির পরিবর্তে এখন কমছে। অথচ শুধু ডলার সংকটে ২০২২ সাল থেকে ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল দেশের অর্থনীতি। ওলটপালট হয়ে যায় দেশের আর্থিক সূচক। যা এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে অর্থ পাচারের কারণে প্রবাসীদের আয় সম্পূর্ণভাবে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হতো না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থের পাচার কমে গেছে। সে কারণেই গেল এক বছরে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। এই বাড়তি অর্থের পুরোটাই আগে অবৈধ পথে (হুন্ডি) আসত বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থ পাচারের বড় অংশই হয়ে থাকে হুন্ডির মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশে প্রবাসীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা কিনে নেয় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। দেশে স্থানীয় মুদ্রায় সেই অর্থ প্রবাসীদের পরিবার বা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। অন্যদিকে যাঁরা বিদেশে অর্থ পাচার করতে চায় তাঁরা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে দেশে স্থানীয় মুদ্রার যোগান দেয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আর বাংলাদেশে প্রবেশ করে না।

পাচারের নয়া মাধ্যম

অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অবৈধ পথই বেছে নিতেন অনেকে। এক্ষেত্রে হুন্ডিকে বেছে নেওয়া হয়। এর ফলে দুই পক্ষের কাছে অর্থ পৌঁছে গেলেও দেশের অর্থনীতিতে তা যোগ হয় না। উল্টো দেশের সম্পদ বিদেশে চলে যায়। তবে এভাবে অর্থ পাচার করাটাও কষ্টসাধ্য।

এ জন্য আরও সহজ পথ বের করা হয়। বেছে নেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় সংগ্রহ করা ইসলামী ব্যাংককে। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৭ সালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকটি দখল করে নেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। একই সময়ে তাঁর মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রন নেয়।

পাশাপাশি বাংলাদেশি শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে রেমিট্যান্স হাউস কিনে নেয় শিল্প গ্রুপটি। এস আলম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রেমিট্যান্স হাউসগুলোতে যে প্রবাসী আয় জমা হতো, তা সেখানে রেখে দেওয়া হতো। তবে এই ব্যাংকগুলো ভুয়া ঋণ তৈরি করে এসব টাকা প্রবাসী আয়ের সুবিধাভোগীদের হিসাবে বা সরাসরি দেওয়া হতো। আদতে সেই ডলার ব্যাংকের হিসাবে যুক্ত হতো না। উল্টো এর মাধ্যমে অর্থ পাচারের বড় মাধ্যমে হয়ে উঠে ব্যাংকগুলো।

তারা জানান, এক সময় বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হলেও গত ৮ বছরে তা বদলে যায়। হুন্ডির অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ হয়ে ওঠে বড় মাধ্যম। অর্থ পাচারে এই মাধ্যম কাজে লাগায় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই চক্র ভেঙে যায়।

ভাঙল চক্র, বাড়ল প্রবাস আয়

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ডলার নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও সংকটের সমাধান করতে পারেনি। এজন্য যথাযথ নীতি অনুসরণ না করাকেই দুষছেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ডলারের দর বাজারভিত্তিক করে দেয়। দর বাজারভিত্তিক করায় ডলারের প্রবাহ বেড়ে যায়। যা সংকট কাটাতে ভূমিকা রাখছে।

বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান প্রবাসীরা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে গেল অর্থবছরে।

অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানিতে সাড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৪৪ দশমিক ৪৭ ডলার।

রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ডলার-সংকট কাটছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বেড়েছে। পাশাপাশি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চিত্রও বদলে গেছে। চলতি হিসাবে বড় ধরনের যে ঘাটতি ছিল, তার অনেকটাই কমে এসেছে, যা স্বস্তি দিচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে। এ ছাড়া ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি স্থির আছে।

কমছে জনশক্তি রপ্তানি

সাধারণত জনশক্তি রপ্তানি যত বাড়ে, প্রবাস আয়ও তত বাড়তে থাকে। তবে তথ্য বলছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও এর পরের বছর তা কমে গেছে। আবার চলতি বছরে জনশক্তি রপ্তানি আরও তলানিতে।

২০২২ সালে প্রবাসে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। ২০২৩ সালে যা বেড়ে হয় ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন। ২০২৪ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমে হয় ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি-মে মাসে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৭২১ জন। সরকার জনশক্তি রপ্তানিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সামনে জনশক্তি রপ্তানি বাড়তে পারে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তবে জনশক্তি রপ্তানি কমলেও প্রবাস আয় বাড়ার কারণ কী? জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী স্ট্রিমকে বলেন, জনশক্তি রপ্তানি কমার পরও এক বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি আসার মানে হলো আগে অবৈধভাবে অর্থ আসত। আর অবৈধ পথে আসা সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যেত। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার ফলে এটা ঠেকানো গেছে।

জনাব মুজেরী আরও বলেন, এখন প্রবাসী আয়ে গতি ধরে রাখতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হবে। এই জন্য সরকারকে উদ্যোগী হয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে হঠাৎ ডলারের সংকট তৈরি হবে না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত