ফুলবাড়ি খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তর্কে জড়িয়েছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। দুদিন আগে এই বিষয়ে শফিকুল আলমের ফেসবুক পোস্টের পর পাল্টা ফেসবুক পোস্ট দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সেই পোস্টে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণের’ ইঙ্গিত দিয়ে আবারও ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন প্রেস সচিব।
আজ রোববার (৭ ডিসেম্বর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘গঠনমূলক বিতর্ক সুস্থ গণতন্ত্রের ভিত্তি। ব্যক্তিগত আক্রমণ বা বিদ্বেষমূলক ভাষা শুধু অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে।’
গত শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) শফিকুল আলম ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, ২০০৬ সালের ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন প্রকল্প বন্ধ করা ছিল জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ‘আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’। এজন্য তিনি বামপন্থীদের সমালোচনা করেন।
পোস্টে তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের বড় কয়লা মজুত অব্যবহৃত রয়ে যায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশকে উচ্চমূল্যে কয়লা ও এলএনজি আমদানি করতে হয়, যা অর্থনীতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
তাঁর মতে, সেই সময়ে বাংলাদেশ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত দ্রুত কমছিল। অথচ চীনসহ বহু দেশ এখনো কয়লার ওপর নির্ভরশীল।
তিনি অভিযোগ করেন, বামপন্থী কর্মী ও প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যম আদর্শগত অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়েছে বাস্তবতার চেয়ে। এর ফলে জ্বালানি নীতিতে নির্ভরতা তৈরি হয় ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানির ওপর।
ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে লেখা এই পোস্টে আলম শেষ পর্যন্ত মন্তব্য করেন, এ ধরনের আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় শক্তিকে দুর্বল করেছে। তার এই মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পরের দিন শনিবার (৬ ডিসেম্বর) অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ তার তীব্র সমালোচনা করে পোস্ট দেন। তিনি অভিযোগ করেন, শফিকুল আলমের বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং তা বাংলাদেশের জনগণকে অসম্মান করে।
আনু মুহাম্মদ লেখেন, ‘টাউট বাটপার কোম্পানির কোলে বসে ফুলবাড়ী নিয়ে তার মন্তব্য বা নড়াচড়া ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করেছে! এসবের যথাযথ জবাব তার প্রাপ্য।’
আনু মোহাম্মদের ওই পোস্টের পরই আজ সকাল ১১টার দিকে শফিকুল আলম এই বিষয়ে ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দেন।
পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘ফুলবাড়ী হত্যাকাণ্ডের খবর বিদেশি গণমাধ্যমে সম্ভবত আমিই প্রথম জানাই। পুলিশকে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি করাতে আমাকে অনেক চেষ্টা করতে হয়েছিল। তখন আমি ঢাকায় এএফপি’র সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এ খবর যুক্তরাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব পায়, কারণ ফুলবাড়ী প্রকল্পের প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠান এশিয়ান এনার্জি লন্ডনে তালিকাভুক্ত ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি তখনও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছি, আজও সেই নিন্দা পুনর্ব্যক্ত করছি। দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে—বিক্ষোভ সামলাতে পুলিশ ও বর্ডার গার্ড অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য এ সহিংসতা ও দমনচক্র ভাঙা।’
শফিকুল আলম জানান, ‘ফুলবাড়ী ওপেন-পিট প্রকল্প নিয়ে আমার সাম্প্রতিক ব্যক্তিগত মন্তব্য এসেছে সরকারের সাথে ১৬ মাস কাজের অভিজ্ঞতা থেকে। বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ, কিন্তু আমাদের সক্রিয়তায় অনেক সময় এই বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়। আমি যদি এখনও এএফপি’তে থাকতাম, তাহলে আজ যে অবস্থানে রয়েছি, তা হয়তো কঠোরভাবে সমালোচনা করতাম।
‘একটি দেশকে এগিয়ে নিতে জ্বালানি নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এ বিষয়টি সরকারে যোগ দেওয়ার পর আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্বের এক অঞ্চলের সংঘাত এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম অন্যত্রও বাড়িয়ে দেয়। ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমরা প্রাকৃতিক গ্যাস সাধারণ দামের পাঁচ থেকে দশগুণ মূল্যে কিনতে বাধ্য হয়েছিলাম। এত উচ্চমূল্য বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন প্রশ্ন দাঁড়ায়—আমরা কি রিজার্ভ ফুরিয়ে এলএনজি কিনব, নাকি মাসের পর মাস কারখানা বন্ধ রাখব?’
তিনি আরও লেখেন, ‘গত দুই দিনে আমার লেখার সমালোচনা যারা করেছেন, তাদের সুচিন্তিত মতামতকে আমি স্বাগত জানাই। মাহতাব উদ্দিন আহমেদসহ অনেকেই আমার যুক্তির ঘাটতি চিহ্নিত করেছেন। তাদের পরিশ্রম ও বিশ্লেষণ আমি মূল্যায়ন করি।
‘তারপরও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ফুলবাড়ী, দিঘিপাড়া ও জামালগঞ্জের মতো বড় কয়লা মজুত থেকে আমরা উত্তোলন না করে ভুল করেছি। এশিয়ান এনার্জির সঙ্গে চুক্তিতে ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে নতুন অংশীদার নির্বাচন করা উচিত ছিল। যেমন বিএইচপি বিলিটন বা রিও টিন্টো। ২০০৬ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র ৬০০–৭০০ ডলার ছিল। তখন আমরা অত্যন্ত দরিদ্র দেশ। ফুলবাড়ী আন্দোলনে কয়লা প্রকল্প বন্ধ হয়নি, বরং ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে আমরা বড় কয়লা আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছি।
শফিকুল বলেন, ‘অনেক সমালোচক হয়তো লক্ষ্য করেননি, লেখাটি আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে লিখেছি। এটি কোনো সরকারি অবস্থান নয়। আমার জানা অনুযায়ী বর্তমান সরকারের ফুলবাড়ী প্রকল্প পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা নেই। এটি শুধুই ব্যক্তিগত অভিমত।’
আবারও বামপন্থীদের সমালোচনা করে তিনি লেখেন, ‘মানবাধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বামপন্থীদের অবস্থানকে আমি সবসময় সম্মান করি। এএফপিতে কাজ করার সময়ে আমি বহু আন্দোলন ও মানবাধিকার কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। এই প্রয়াস মূল্যবান।
‘তবে অর্থনৈতিক অনেক বিষয়ে বামপন্থীদের অবস্থান বাস্তবসম্মত হয়নি বলে আমার মনে হয়। তাদের আন্দোলন সবসময় কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় প্রতিবাদ কখনও কখনও প্রযুক্তিবিরোধী অবস্থানের মতো মনে হয়েছে। ইতিহাস বলছে, শিশুশ্রম নির্মূল, কারখানার নিরাপত্তা বৃদ্ধি, শ্রমিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের মতো বড় অগ্রগতি মূলত এসেছে পশ্চিমা ক্রেতা ও ভোক্তা আন্দোলনের চাপের কারণে, আমাদের স্থানীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে নয়।’