leadT1ad

রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাম্পাসের হাজার গাছ লুট করে নিল কারা?

স্ট্রিম সংবাদদাতারাজশাহী
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ০৭
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ০০
ক্যাম্পাসের অনেক জায়গাই এখন এমন ফাঁকা হয়ে গেছে। স্ট্রিম ছবি

২০৫ বিঘা আয়তনের বিশাল জায়গা। এর অনেকটা জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আম ও মেহেগনি গাছ। কিছু জায়গা পড়ে আছে ফাঁকা। সেখানে শাক-সবজির চাষবাস হচ্ছে। রাজশাহী নগরের সিলিন্দায় এই বিশাল এলাকাজুড়েই গড়ে উঠবে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) ক্যাম্পাস। এ জন্য ব্যক্তিমালিকানার বাগান, ভবনসহ যেখানে যা ছিল, তার সবকিছুই সরকার অধিগ্রহণ করেছে। এই জায়গা থেকে সম্প্রতি লুট হয়ে গেছে অনেক গাছ।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ওই ক্যাম্পাসে গাছ আছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। গাছ বিক্রির জন্য নাম্বারিংও করা হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো দরপত্র হয়নি, কাউকে কার্যাদেশও দেওয়া হয়নি। অথচ গত প্রায় ১০ মাস ধরে একটার পর একটা গাছ কাটা হয়েছে। এর ফলে গাছ-গাছালিতে ভরে থাকা জায়গার অনেক অংশই ফাঁকা হয়ে পড়েছে। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে বালু ভরাটের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গাছগুলো কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।

ক্যাম্পাসে বালু ভরাটের কাজটি করছে ঢাকার মিরপুরের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হোসাইন কন্সট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির রাজশাহীর ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো শুধু বালুভরাট করছি। যেদিকে গাছ কাটা হয়েছে, সেদিকে আমাদের কোনো কাজ নেই। সুতরাং, কারা গাছ কেটেছে বলতে পারব না।’

এখনও অনেক জায়গায় পড়ে আছে কাটা গাছ। স্ট্রিম ছবি
এখনও অনেক জায়গায় পড়ে আছে কাটা গাছ। স্ট্রিম ছবি

সরেজমিনে যা দেখা গেল

ক্যাম্পাসের জন্য নির্ধারিত এলাকাটি সম্প্রতি ঘুরে দেখা গেছে, গোড়া থেকে অসংখ্য গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। তারপর গাছের নিচের অংশটি মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আর অনেক গাছ কাটা হয়েছে মাটি খুঁড়ে। বৃষ্টির কারণে ছোট ছোট পুকুরের মতো সেসব গর্তে পানি রয়ে গেছে। ক্যাম্পাসজুড়ে এমন খাল অসংখ্য। ক্যাম্পাসের পূর্ব পাশ দিয়ে ড্রেনের সঙ্গে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি করতে কয়েক শ গাছ আগেই কাটা হয়েছে।

বুধবার (২০ আগস্ট) বিকেলে পূর্বপাশের রাস্তা দিয়ে কিছুটা পশ্চিমে যাওয়ার পর হাতের বাঁয়ে পাওয়া গেল শ্রমিকদের থাকার একটি টিনের ঘর। তার পাশেই গোড়া থেকে কাটা দুটি আমগাছ এখনও পড়ে আছে। কারা গাছ কেটেছে জানতে চাইলে শ্রমিকেরা ‘জানেন না‘ বলে জানালেন।

আরেকটু দক্ষিণে এগোতেই চোখে পড়ল কিছু গাছের কাটা ডালপালা। এই এলাকাটিতে অনেক গাছ কেটে সাবাড় করে দেওয়া হয়েছে। জায়গাটি ফাঁকা হয়ে পড়েছে। পশ্চিম দিকে গিয়ে দেখা গেল, গাছ কেটে জায়গা ফাঁকা করে সেখানে পুঁইশাক চাষ করা হয়েছে। আরও পশ্চিমে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ১০ বিঘা আয়তনের একটি বাগানে সারি সারি গাছ কাণ্ড থেকে কাটা অবস্থায় পড়ে আছে। শুকনো ডালপালা নিয়ে গাছগুলো পড়ে আছে হাঁটুসমান পানিতে। পানির কারণে গাড়ি নিয়ে এসে এই গাছগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাগানের গাছের এক সারি পর আরেক সারির সবগুলো কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। ওই বাগানে অর্ধশতাধিক গাছ কাটা অবস্থায় দেখা গেছে। গাছগুলোতে রং দিয়ে নম্বরও লেখা আছে।

গাছের ডালপালা নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। স্ট্রিম ছবি
গাছের ডালপালা নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। স্ট্রিম ছবি

ক্যাম্পাসের ভেতরের এই বাগানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আবদুল মমিন নামের এক কিশোর। সে জানাল, ১০ হাজার টাকা বেতনে সে এই ক্যাম্পাস দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত। কারা গাছ কেটেছেন, তা সে বলতে চাইল না। একটু উত্তর দিকে এগোতেই পাওয়া গেল স্থানীয় বাসিন্দা ববিতা বেগমকে। তিনি ঘাস কাটছিলেন। ববিতা জানান, মাঝে মাঝেই গাছ কাটা হতো। গত একমাস ধরে গাছ কাটা লেগেই ছিল। ট্রলিতে করে গাছ এখান থেকে কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা জানেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গাছ বিক্রি করে দিয়েছে।

আরেকটু সামনে এগোতে একটি বাগানের সব গাছ কেটে নেওয়ার চিত্র দেখা গেল। কেটে নেওয়া গাছের গোড়া থেকে বোঝা গেল, এটি মেহগনি বাগান ছিল। তার পাশে আরেকটি ফাঁকা জায়গা দেখে মনে হলো, এটি আমবাগান ছিল। এখনও সেখানে কিছু কাটা ডালপালা পড়ে আছে। এর পশ্চিম দিকেও কেটে রাখা ডালপালা চোখে পড়ল। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে যেতেই একটি সরু খাল পাওয়া গেল। খালের ওপাশে গাছের কিছু চিকন চিকন ডাল নিয়ে বসেছিলেন তিন নারী। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা শেষ কি না জানতে চাইলে মজা করে এক নারী বললেন, ‘ওইদিক বিশ্ববিদ্যালয়, আর এই দিক বাংলাদেশ।’

আলাপে জানা গেল, ওই নারীর নাম শারমিন বেগম। তিনি জানান, সবশেষ মঙ্গলবার সকালেও দুই ট্রলি গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার আগের দুই দিনেও দুই ট্রলি করে চার ট্রলি গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেমন গাছ ছিল জানতে চাইলে শারমিন বললেন, ‘এখানে যেমন আমরা বাগানে বসে আছি, ওইদিকেও একই রকম বাগান ছিল। এখন তো ফাঁকা।’

দুই হাত প্রসারিত করে পাশেই বসে থাকা নাসিমা খাতুন নামের আরেক নারী বললেন, ‘এই রকম মুটা মুটা গাছ ছিল। সব কাইটে সাবাড় কইরি দিল। কারা কাইটলো, আমরা বুইলতে পাইরব না। আমরা শুধু একটু খড়ি কুড়িয়ে আইনিছিলাম, কাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক আইস্যা বুলল যে সব খাড়ি যেন রাইখ্যা আসি। তা না হোলি পুলিশ আইসি ধইরবে।’

এখান থেকে ফেরার পথে দেখা গেল, বন্ধগেট-সিটিহাট সড়কের পাশে কয়েকটি ভবন ভাঙা হচ্ছে রামেবির স্থাপনা নির্মাণের জন্য। এই ভবনগুলোর চারপাশ থেকেও গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। এখনও ভবনগুলোর চারপাশে কাটা গাছের গুঁড়ি ও ডালপালা পড়ে আছে।

কে কাটল গাছ

এই ক্যাম্পাসে হাফিজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির গরু ও ভেড়ার ফার্ম ছিল। সেটি ক্যাম্পাসের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনিই অলিখিতভাবে এই ক্যাম্পাস দেখাশোনার সব দায়িত্বে আছেন। কিশোর আবদুল মমিন জানাল, সে, তার নানা কাজিম ও নানি বিউটি বেগমও ক্যাম্পাস দেখাশোনা করে। তাদের বেতন দেন হাফিজুল। গাছ কাটল কে, এমন প্রশ্নে হাফিজুল বললেন, ‘তা আমি বলতে পারব না ভাই। আমার এখানে ফার্ম ছিল, অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। তারপর আমার কাজ শেষ। আমি কাউকে দেখাশোনার জন্য রাখিনি।’

পানি আটকে থাকায় কিছু গাছ নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি এখনও। স্ট্রিম ছবি
পানি আটকে থাকায় কিছু গাছ নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি এখনও। স্ট্রিম ছবি

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, এই হাফিজুল এবার আমের মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন বাগান থেকে। একটি রাজনৈতিক দলের সাবেক এক ছাত্রনেতা নামমাত্র মূল্যে বাগানগুলো ইজারা নিয়েছিলেন। গাছ খেকো চক্রের সঙ্গে এই হাফিজুল, সাবেক ওই ছাত্রনেতা, বালু ভরাটের কাজ পাওয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, রামেবির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. হাসিবুল হোসেন এবং উপাচার্য ডা. মোহা. জাওয়াদুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হোসেন জড়িত বলে সূত্রটি দাবি করেছে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারাও আগে থেকেই গাছ কাটার বিষয়টি জানত বলেও সূত্রের দাবি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. হাসিবুল হোসেন বলেন, ‘গাছ কাটার বিষয় আমি জানতেই পারি। আপনি যেমন জানতে পারেন, আমিও জানতে পারি। তার মানে তো সেটা অফিশিয়াল না। আমি তো প্রকল্প এলাকায় যাই-ই না। আমার নাম কেন আসবে?’

উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হোসেনও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজই আরেকজন সাংবাদিক এসে আমাকে একই প্রশ্ন করেছেন। আমি তো ভাই কিছুই জানি না।’

ঠিকাদারকে শোকজ

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ১০ মাস ধরে একটি-দুটি করে গাছ কাটা হচ্ছিল। মাসখানেক ধরে প্রচুর গাছ কাটা শুরু হলে এবং ট্রলিতে করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন মহলে জানাজানি হয়। কারা গাছ কাটার কাজ পেয়েছে, এর খোঁজখবর নিতে গিয়ে দলীয় কিছু নেতাকর্মী জানতে পেরেছেন যে, গাছ কাটার কোনো দরপত্রই হয়নি। এরপর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বালু ভরাটের কাজ পাওয়া হোসাইন কন্সট্রাকশন লিমিটেডকে শোকজ করে একটি চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ও রামেবির পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘গাছ আমাদের পক্ষ থেকে কাটা হয়নি। গাছ কাটা হয়েছে ঠিকাদারের পক্ষ থেকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে, বেআইনিভাবে। আমরা তাকে প্রাথমিকভাবে শোকজ করেছি। তারা যে জবাব দেবে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’

তিনি নিজে গাছ খেকো চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, ‘তাহলে তো শোকজ করতাম না। আমাদের চুক্তিতে এমন কিছু নেই যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বালু ভরাট করতে এসে গাছ কাটবে। আমরা কয়েকদিন আগেই বিষয়টা জানতে পেরেছি। তারপর শোকজ করেছি। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই হয়তো শোকজের জবাব আসবে।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বুধবার সন্ধ্যায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির রাজশাহীর ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা গাছ কাটিনি। যেদিকে গাছ কাটা হয়েছে, সেদিকে আমাদের কোন কাজ নেই। ওই দিকে এখন পর্যন্ত আমরা যাইনি। এভাবেই শোকজের জবাব দেব। বনবিভাগ থেকে লোকজন এসেছিল, তাদেরকেও একই কথা বলেছি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত