leadT1ad

কুম্ভমেলায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ভারত সরকারের লুকোচুরি

ভারত সরকার কুম্ভমেলায় ৩৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে আরও ২৬টি পরিবারকে। এ ছাড়া আরও ১৮টি মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।

তুফায়েল আহমদ
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৮: ০১
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১০
কুম্ভমেলায় ভিড়ে চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনার পর ব্যারিকেড টপকে পালানোর চেষ্টা করেন অনেকে। ছবি: বিবিসি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কুম্ভমেলায় ভিড়ে চাপা পড়ে (ক্রাউড ক্রাশ) যত মানুষের মৃত্যুর কথা ভারত সরকার স্বীকার করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভারত সরকার মৃত্যুর সংখ্যা লুকিয়েছে। বিবিসি হিন্দির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ভারত সরকার কুম্ভমেলায় ৩৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে আরও ২৬টি পরিবারকে। এ ছাড়া আরও ১৮টি মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।

গত ২৫ মার্চ ভারতের উত্তর প্রদেশ (ইউপি) রাজ্যের সাদা পোশাকধারী পুলিশের একটি দল পাশের বিহার রাজ্যের গোপালগঞ্জে সহায়তার টাকা নিয়ে যায়। সেখানে তারা ৬২ বছর বয়সী তারা দেবীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে। পুলিশ তারা দেবীর ছেলে ধনঞ্জয় গোঁড়কে পাঁচ লাখ রুপি দেয় এবং টাকা প্রাপ্তির বিষয়টি উল্লেখ করে ভিডিওতে বক্তব্য রেকর্ড করতে বলে।

ভিডিওতে ধনঞ্জয় নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমি ও আমার মা তারা দেবী কুম্ভমেলায় পবিত্র স্নানের জন্য গিয়েছিলাম। আমার মা মারা গেছেন। উত্তর প্রদেশ থেকে অফিসাররা এসে আমাদের পাঁচ লাখ রুপি দিয়েছেন। আমরা তা গ্রহণ করেছি।’

ধনঞ্জয়ের ভাষ্যমতে, তাঁর মা ২৯ জানুয়ারি ইউপির প্রয়াগরাজে ভিড়ে চাপা পড়ে মারা যান।

উত্তর প্রদেশ সরকার দাবি করেছে, তারা ৩৫টি পরিবারকেই ২৫ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। বাকি দুজনের মধ্যে একজনের পরিচয় মেলেনি এবং একজনের কোনো উত্তরাধিকারী নেই বলে এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়নি।

উত্তর প্রদেশ সরকার এখনো নিহত ব্যক্তিদের কোনো সরকারি তালিকা প্রকাশ করেনি। তারা দেবীর ছেলে জানান, পুলিশ তাকে বলেছে যে ২৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি হিসেবে তিনি ৫ লাখ রুপি পেয়েছেন। তিনি এখনো বাকি ২০ লাখ রুপি পাননি।

উত্তর প্রদেশ সরকার দাবি করেছে, তারা ৩৫টি পরিবারকেই ২৫ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। বাকি দুজনের মধ্যে একজনের পরিচয় মেলেনি এবং একজনের কোনো উত্তরাধিকারী নেই বলে এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়নি।

তবে বিবিসির তথ্য মতে, ২৫ লাখ রুপির চেক মাত্র একটি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। ৩৫টির ক্ষেত্রে টাকা আত্মীয়দের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে।

এ ছাড়া তারা দেবীর ঘটনার মত পুলিশ সরাসরি বাড়িতে গিয়ে নগদ ৫ লাখ রুপি দিয়েছে এমন ২৬টি ঘটনা পাওয়া গেছে।

অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সমস্যায় মৃত্যু হয়েছে—মৃতদের পরিবারকে এমন কাগজে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে। যদিও পরিবারগুলো জোর দিয়ে বলেছে, তাঁদের আত্মীয়রা ভিড়ে চাপা পড়েই মারা গেছেন।

উল্লেখ্য, ১২ বছর পরপর হওয়া কুম্ভমেলায় প্রাকৃতিক মৃত্যুকে উত্তর প্রদেশ সরকার ক্ষতিপূরণ আওতায় আনে না।

বিবিসি আরও ১৮টি মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করেছে, যেখানে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।

উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দাবি করেছিলেন, এবারের কুম্ভমেলায় ভিড়ে চাপা পড়ার ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি। কিন্তু ২৯ জানুয়ারি প্রয়াগরাজে চারটি আলাদা জায়গায় ভিড়ে চাপা পড়ার ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি।

সরকারি হিসাবে, এ বছর কুম্ভমেলায় ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছে। ছবি: বিবিসি
সরকারি হিসাবে, এ বছর কুম্ভমেলায় ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছে। ছবি: বিবিসি

কুম্ভের ঘটনার পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে ভারতের ১১টি রাজ্যে ১০০টির বেশি পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে বিবিসি। যাঁদের দাবি, তাঁদের আত্মীয়রা ওই ট্র্যাজেডিতেই মারা গেছেন। সন্দেহজনক কেস বাদ দিয়ে প্রমাণসহ মোট ৮২টি মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করেছে বিবিসি।

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, মর্গ স্লিপ, মৃত্যুসনদ, ছবি ও ভিডিও প্রমাণ হিসেবে সংগ্রহের পাশাপাশি বিবিসি স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন যাচাই করেছে এবং জেলার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে কোথা থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তা চিহ্নিত করেছে।

ঘটনার টাইমলাইন স্পষ্ট করার জন্য মৃতের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিশদ সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। কবে তাঁরা স্নানের জন্য রওনা হন, কখন ভিড়ে চাপা পড়েন, কাছাকাছি কোন স্থাপনা ছিল কি না, স্নানস্থল থেকে কত দূরে ঘটনাটি ঘটে—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে বিবিসি।

এই বিশদ বিবরণ থেকে সঙ্গম নোজ, চৌরাহা, ঐরাবত মার্গ এবং মুক্তি মার্গ চৌরাহা—এ চারটি জায়গায় ভিড়ে চাপা পড়ার ঘটনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

মৃতদেহের ছবি ও ময়নাতদন্ত সময়ের শনাক্ত নম্বরের মাধ্যমে আরও পাঁচটি মৃতদেহ চিহ্নিত করেছে বিবিসি। এর মধ্যে তিনজনের পরিবার পাঁচ লাখ রুপি পেয়েছে কিন্তু বাকি দুজনের পরিবার কিছুই পায়নি। কিছু পরিবারের কাছে আত্মীয়দের মৃতদেহ ছবি থাকা সত্ত্বেও সরকার এসব মৃত্যু স্বীকার করেনি।

ক্ষতিপূরণের পুরো ২৫ লাখ রুপি পেয়েছেন এমন কেসগুলোর অধিকাংশেই মৃত্যুর স্থান হিসেবে বলা হয়েছে সঙ্গম নোজ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের, ‘৭ নম্বর ওয়ার্ড, ফোর্ট ক্যান্টনমেন্ট’।

যেসব ঘটনায় ৫ লাখ রুপি দেওয়া হয়েছে, সেসব ঘটনায় মৃত্যুর স্থান হিসেবে বলা হয়েছে, ‘সেক্টর ২০ অথবা সেক্টর ২১, কুম্ভমেলা, ঝুঁসি’। সঙ্গম নোজের ঘটনার ভয়াবহতা কমিয়ে দেখানোর জন্য অনেক মৃত্যুর ঘটনা জোর করে ঝুঁসির দেখানো হয়েছে বলে কিছু পরিবার দাবি করছে।

উত্তর প্রদেশ সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁরা প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

বিবিসি সঙ্গম নোজ ছাড়া অন্য স্থানেও ভিড়ে চাপা পড়ে মৃত্যুর প্রমাণ পেয়েছে। এই ক্ষেত্রেও সরকার কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, যা ঘটনাগুলোর প্রমাণ আকারে উপস্থিত হচ্ছে।

উত্তর প্রদেশের জৈনপুরের ধর্মরাজ রাজভর তাঁর স্ত্রী ও পুত্রবধূর মৃত্যুর জন্য পাঁচ লাখ রুপি করে পেয়েছেন। তাঁরা ঐরাবত মার্গে ভিড়ে চাপা পড়ে মারা যান।

২৯ জানুয়ারি ধারণ করা বিবিসির একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাজভর পরিবার দুই মৃতদেহের সঙ্গে সেই স্থানে বসে আছে। বাড়ি ফিরে ধর্মরাজ রাজভর টাকার বান্ডিল দেখিয়ে বলেন, ‘সরকার ২৫ লাখ রুপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু পুলিশ মাত্র ৫ লাখ রুপি করে দিয়ে চলে গেছে।’

‘আমার স্বামী ২৯ জানুয়ারির সকাল ৮টার দিকে মারা যান। মানুষ তাঁর শরীরের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি দুপুর ৪টা পর্যন্ত লাশের পাশে বসেছিলাম। কেউ পানি পর্যন্ত দেয়নি।’ -মৃত পান্নে লাল সাহনির স্ত্রী কুসুম দেবী।

উত্তর প্রদেশ পুলিশ কয়েক শ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম বর্ধমান গিয়েও বিনোদ রুইদাসের পরিবারকে পাঁচ লাখ রুপি দিয়েছে।

সব পরিবার অবশ্য ক্ষতিপূরণ নেয়নি। বিহারের সুনয়না দেবীর আত্মীয়রা টাকা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ভুয়া কাগজে স্বাক্ষর করে তাঁরা টাকা নিতে রাজি নন।

বিবিসি অন্তত পাঁচটি পরিবারকে চিহ্নিত করেছে, যাদের পরিবারের সদস্য সঙ্গম নোজ থেকে প্রায় তিন-চার কিলোমিটার দূরে কল্পবৃক্ষ গেটের কাছে মারা গেছেন।

পান্নে লাল সাহনির স্ত্রী কুসুম দেবী বলেন, ‘আমার স্বামী ২৯ জানুয়ারির সকাল ৮টার দিকে মারা যান। মানুষ তাঁর শরীরের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি দুপুর ৪টা পর্যন্ত লাশের পাশে বসেছিলাম। কেউ পানি পর্যন্ত দেয়নি।’ তবে কুসুম দেবী ক্ষতিপূরণের আংশিক পাঁচ লাখ রুপি পেয়েছেন।

কল্পবৃক্ষ গেটের কাছে যে পাঁচজন মারা গেছেন তাদের পরিবার-পরিজনের দাবি, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা মৃতদেহ নিয়ে বসে ছিলেন। কেউ কোনো সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও ১৮টি পরিবার সামনে এসেছে, যারা দাবি করেছে, তাদের আত্মীয়ও ভিড়ে চাপা পড়ে মারা গেছে কিন্তু এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি।

উত্তর প্রদেশের সুলতানপুরের মিনা পান্ডে এই ১৮টি কেসের একটি। মিনা পান্ডে তাঁর স্বামী ও প্রতিবেশী অর্চনা সিংহর সঙ্গে কুম্ভে যান। অর্চনা জানান, মৃত্যুর সাত ঘণ্টা পরও ভিড়ে চাপা পড়ার স্থানে তিনি মিনার দেহের পাশে বসে ছিলেন।

যদিও দাবি করা হয়েছে ২৭৫০টি এআই চালিত সিসিটিভি, ৫০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী, ড্রোন ও অ্যাম্বুলেন্স ছিল। কিন্তু মৃতদের আত্মীয়রা দাবি করেছেন, কোনো সহায়তা পৌঁছায়নি সেখানে।

অর্চনা সিংহ আরও বলেন, দুপুরের দিকে মৃতদেহ পচতে শুরু করলে নিজেদের গাড়িতে করে মরদেহ নিয়ে আসতে হয়েছে।

মিনা পান্ডের পরিবারের মতোই উত্তর প্রদেশের দেওরিয়ার শ্যামলাল গোঁড়ের পরিবারও ক্ষতিপূরণের জন্য অপেক্ষা করছে।

শ্যামলাল গোঁড়ের ছেলে ভাগীরথি গোঁড় ব্যাঙ্গালুরুতে দিনমজুরের কাজ করেন। ভিড়ে চাপা পড়ার ঘটনার পর তিনি তাঁর বাবাকে খুঁজতে প্রয়াগরাজ যান। ৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এক হাসপাতালে বাবার লাশ শনাক্ত করেন। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, শ্যামলাল গোঁড়কে ২৯ জানুয়ারি সকাল ১০টা ২ মিনিটে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ভাগীরথি বলেন, হাসপাতাল কর্মীরা তাঁকে মৃত্যুসনদ বা অন্য কোনো কাগজ দিতে রাজি হয়নি। চার মাস পর বাবার মৃত্যুসনদ পেলেও ভাগীরথি এখনো ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায় আছেন।

(বিবিসি অবলম্বনে তুফায়েল আহমদ)

Ad 300x250

সম্পর্কিত