leadT1ad

আগস্টে আসছে নতুন অটোরিকশা, কী হবে পুরোনোগুলোর

ঢাকায় হু হু করে বাড়ছে অটোরিকশা। এরই মধ্যে আগামী আগস্ট থেকে নতুন মডেলের অটোরিকশা নামানোর ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এতে কপালে শঙ্কার ভাঁজ পড়েছে প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের। নতুন অটোরিকশা এল, কী হবে পুরোনোগুলোর।

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৪৮
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ২০: ৩২

আগামী আগস্টে পথে নামছে নতুন মডেলের অটোরিকশা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এমনটিই জানিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একদল গবেষক ব্যাটারিচালিত রিকশার নতুন এই মডেল তৈরি করেছেন। ডিএনসিসি ইতিমধ্যে নতুন রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে।

নকশাকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, প্রচলিত ইজিবাইকের মতোই হবে বুয়েটের তৈরি নতুন এই রিকশা। এর দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ দেড় মিটার ও উচ্চতা ২ দশমিক ১ মিটার। রিকশাটি ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারবে।

নতুন রিকশায় থাকবে হাইড্রোলিক ব্রেক, ইন্ডিকেটর, লুকিং গ্লাস, ছাউনি, কাচের উইন্ডশিল্ড ও হেডলাইট। এর হেডলাইটে যুক্ত করা হয়েছে ‘হাই বিম’, ‘লো বিম’ ও ‘ডিআরএল’ (ডে টাইম রানিং ল্যাম্প)। চলাচলের সময় সড়ক দেখতে এবং অন্য যানবাহনের চালকের দৃষ্টিগোচর করতে সহায়তা করবে এই বাতি।

বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসান নকশাকারী দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্ট্রিমকে জানান, প্রচলিত ১২ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশার নিরাপত্তা ত্রুটি খুঁজে বের করেছেন তাঁরা। সেসব ত্রুটি বিবেচনায় নিয়ে নতুন মডেলে ১৬টি বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়েছে।

দাম কেমন পড়তে পারে

বাণিজ্যিকভাবে এই রিকশা তৈরির খরচ দেড় থেকে ২ লাখ টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন রিকশা তৈরিতে আগ্রহী, তার মধ্যে একটি হলো বিভাটেক। বিভাটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান সাঈদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘রিকশাপ্রতি দেড় লাখ টাকা বা তার কিছুটা বেশি খরচ হতে পারে।’

ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘খরচটা আমরা ২ লাখ টাকার ভেতরেই রাখব যেন গরিব মানুষ রিকশাটা কিনে চালাতে পারেন।’

বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম অবশ্য দাবি করেছেন, নতুন মডেলের এই রিকশা ১ লাখ টাকার মধ্যে তৈরি করা সম্ভব।

স্ট্রিমকে নাদিম বলেন, বর্তমানে স্থানীয় গ্যারেজে যেসব ইজিবাইক (মিশুক) তৈরি করা হয়, সেগুলোর খরচ পড়ে ৭০-৭৫ হাজার টাকা। আর নতুন মডেলের রিকশাটি মিশুকের মতোই। শুধু ইন্ডিকেটর, ব্রেক আর ছাদের মতো কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ বাড়তে পারে।

উৎপাদন নিয়ে বিতর্ক

প্রাথমিকভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নতুন রিকশা উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার গুঞ্জন উঠেছে। এ নিয়ে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো।

রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য সচিব ও বাসদ নেতা মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি, কয়েকটা প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন যদি ‘মনোপলি’ (একচেটিয়া) মার্কেটিং করে নিজেদের লোকের হাতে উৎপাদন ক্ষমতা দেন, তাহলে এখানে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হবে।’

আরিফুল ইসলাম নাদিম বলেন, ‘বিশেষ একটা গোষ্ঠীকে লাভবান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সিটি করপোরেশন। আমরা চাই নতুন রিকশার নকশা উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। কোম্পানিকে বরাদ্দ না দিয়ে লোকাল গ্যারেজে তৈরি করা যায় এসব রিকশা। তৈরির পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সেটার ফিটনেস চেক করতে পারে। এতে বড় অর্থনৈতিক বাজার তৈরি হবে।’

তবে মনীষা চক্রবর্তী ও আরিফুল ইসলাম নাদিম কেউই কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি।

এ দিকে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ‘উৎপাদন-বরাদ্দ’ দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘কাউকে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে রিকশা উৎপন্ন করতে চায়, তাদের নমুনা দিতে বলা হয়েছে। আমরা একটা এ্যাপ্রুভাল (অনুমোদন) কমিটি গঠন করেছি। এই কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে, কোন কোম্পানি বরাদ্দ পাবে আর কারা পাবে না।’

ঢাকায় বেড়েছে অটোরিকশা। ছবি: আশরাফুল আলম
ঢাকায় বেড়েছে অটোরিকশা। ছবি: আশরাফুল আলম

‘সিটি করপোরেশন কি লাইসেন্স দিতে পারে?’

একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি কার্ড) বিপরীতে তিনটি রিকশার লাইসেন্স দেবে সিটি করপোরেশন। প্রশাসক এজাজ জানিয়েছেন, রিকশার মালিক হবেন তার চালক। তাই একটি এনআইডির বিপরীতে তিনটি রিকশার বেশি লাইসেন্স দেওয়া হবে না।

অন্যদিকে, সিটি করপোরেশন যান্ত্রিক গাড়ির লাইসেন্স দিতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন মনীষা চক্রবর্তী। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘যন্ত্র চালিত বা ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার রাখে বিআরটিএ। সিটি করপোরেশন যান্ত্রিক গাড়ির লাইসেন্স দিতে পারে, এটা আমাদের জানা নাই এবং এটা তাদের বিধানেও নাই।’

আরিফুল ইসলাম নাদিম বলেন, ‘ঢাকার ৭ লাখ রিকশা শ্রমিকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ হাজার জন রিকশা কিনে চালাতে পারবেন। বাকিরা রিকশা কিনতে পারবেন না, লাইসেন্সও পাবেন না। ফলে বড় সংখ্যক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন।’

আলোচনায় ‘ব্যাটারি’

প্রচলিত অটোরিকশায় সাধারণত দুই ধরণের ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। লিথিয়াম ও পাউডার। এর মধ্যে বেশি ব্যবহার করা হয় পাউডার ব্যাটারি।

ধানমন্ডিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করেন মো. শিমুল। স্ট্রিমকে শিমুল বলেন, ‘আমরা শুধু বডি তৈরি করি। যারা রিকশা কেনে, তাঁরা নিজেদের পছন্দ মতো ব্যাটারি কিনে ব্যবহার করেন। তবে পাউডার ব্যাটারি বেশি চলে। পুরাতন ব্যাটারি অর্ধেক দামে ফেরত দিয়ে নতুন ব্যাটারি কেনার ব্যবস্থাও রয়েছে।’

বিভাটেকের পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘ব্যাটারির ব্যাপারে আমরা জানি না। আমরা শুধু রিকশার বডি তৈরি করব। ক্রেতা নিজের পছন্দ মতো ব্যাটারি কিনে নিতে পারবেন।’

বাড়তে পারে ভাড়া

নতুন রিকশার দাম বেশি হওয়ায় ভাড়া বাড়ার আশঙ্কা করছেন চালক ও শ্রমিক নেতারা। হাজারীবাগের রিকশাচালক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন যে রিকশা চালাই, নতুন রিকশার দাম শুনতাছি তারচেয়ে ডাবল। এহন ডাবল দাম দিয়া রিকশা কিইনা ভাড়া তো একটু বেশিই নেওয়া লাগবো।’

নাদিম বলেন, ‘গ্যারেজ মালিকরা বেশি দামে রিকশা কিনে বেশি জমা নেবেন। ফলে চাপ পড়বে যাত্রীদের ওপর। ভাড়া অবশ্যই বাড়বে।’

তবে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ভাড়া বাড়বে কি না, সেটা এখনই বলতে পারছি না। তবে আমরা এলাকাভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে দেব। সব সময়ই যেটা করা হয়।’

কী হবে পুরোনো রিকশার

নতুন রিকশার খবরে শঙ্কায় রয়েছেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকেরা। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকায় ৭ লাখের বেশি রিকশা চলাচল করে। এর একটি বড় অংশ প্যাডেলচালিত রিকশা। বাকিগুলো ব্যাটারিচালিত।

নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করে মোহাম্মদপুরের রিকশাচালক আব্বাস আলী স্ট্রিমকে বলেন, ‘সরকার নতুন রিকশা আনলে আমাদের কী হবে? আমাগো যদি অবৈধ করে দেয়, আমরা যাবো কই?’

তবে নতুন রিকশা আসামাত্র পুরোনো রিকশা অবৈধ ঘোষণা করা হবে না বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় নতুন রিকশা নামাব। আস্তে-ধীরে এলাকা বাড়বে, রিকশা বাড়বে। পুরোনো রিকশাগুলোও সে অনুপাতে বন্ধ করা হবে।’

স্থায়ী সমাধান চান শ্রমিক নেতারা

সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ উল্লেখ করে স্থায়ী সমাধান চেয়েছেন শ্রমিক নেতারা। তাঁদের প্রস্তাব হলো, নকশা উন্মুক্ত করে স্থানীয় গ্যারেজকে উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া হোক। সিটি করপোরেশন নয়, বরং লাইসেন্স হোক বিআরটিএর মাধ্যমে।

নাদিম বলেন, ‘গত ১২ বছর ধরে আমরা এই নকশার আবেদন জানিয়ে এসেছি। সরকার শেষমেষ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এর নকশা উন্মুক্ত করে স্থানীয় গ্যারেজে উৎপাদনের অনুমতি দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের মতো একটা খরুচে এবং কালক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে লাইসেন্সের দায়িত্ব নিয়ে বিআরটিএর কাছে হস্তান্তর করতে হবে।’

মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘বিশেষ গোষ্ঠীর মাধ্যমে গাড়ি উৎপাদনের ষড়যন্ত্র থেকে সরে আসতে হবে। বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্স এবং রেজিস্ট্রেশন প্রদান করতে হবে। শ্রমিকদের সব ধরনের হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে হবে।’

কী বলছেন গবেষকেরা

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন গণপরিবহনের দিকে ঝুঁকছে, তখন ছোট গাড়িতে উৎসাহ দিতে নারাজ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যাতায়াত ব্যবস্থা বুঝে ছোট গাড়ি থেকে সরে আসতে হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক স্ট্রিমকে বলেন, ‘আপনি যত প্রশিক্ষণ আর যত ফিচারই যুক্ত করেন, তাতে কোনো লাভ হবে না। ছোট গাড়ি দিন শেষে শুধু ভোগান্তিই বাড়াবে।’

শামসুল হক বলেন, ‘আমাদের দায়িত্বশীলদের আগে পার্থক্য বুঝতে হবে। ছোট গাড়ি বলতে শুধু রিকশা, সিএনজি বা মোটরবাইক নয়। প্রাইভেটকারও ছোট গাড়ি। এসব ব্যাক্তিগত ছোট গাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের গণপরিবহনমুখী হতে হবে। তাহলে রাস্তার জ্যাম কমবে, মানুষের সময় বাঁচবে।’

যাত্রীবান্ধব বাস তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরে শামসুল হক বলেন, ‘লক্কর-ঝক্কর’ বাস বাদ দিয়ে যাত্রীবান্ধব বাস তৈরি করতে হবে। মানুষ মেট্রোরেলের মতো সেসব বাসে উঠতেও যেন আগ্রহবোধ করেন। বাসে যেন সব রকম মানুষ যাতায়াত করতে পারেন।

উল্লেখ্য, বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসানের নেতৃত্বে নকশাকারী দলে আরও ছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এ সালাম আকন্দ, মো. আমান উদ্দীন ও তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান।

গবেষণা প্রকৌশলী হিসেবে ছিলেন মো. আসাদুজ্জামান ও আবদুল আজিজ ভুঁইয়া। গবেষণা প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি)।

Ad 300x250

সম্পর্কিত