leadT1ad

যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে মায়ান ভাষা

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৫, ২৩: ৪৬

যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী তরুণদের হাত ধরে নতুন প্রাণ পাচ্ছে প্রাচীন মায়ান ভাষাগুলো। গুয়াতেমালা, মেক্সিকোসহ মধ্য আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন নতুন দেশে। ভাষা এখন শুধু পরিচয়ের মাধ্যম নয়, বরং এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণের প্রতীক। বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন শতাব্দীকা ঊর্মি

তিন দিন হলো অ্যারোল্ডোর বাবা মারা গেছেন। এখনো কাঁধে রয়ে গেছে শোকের ভার, চোখে জমে আছে অপূর্ণতা। গুয়াতেমালার সান হুয়ান আতিতান শহরে বাবার রেখে যাওয়া ভুট্টাখেতের দিকে যাওয়ার শক্তিও হয়নি তার। রাতে মায়ের সঙ্গে খেতে বসে, মাম ভাষায় সে বলেছিল, ‘নান, ওয়াখি চিক্স তুজ কাইতানুম মেশ।‘ যার অর্থ, ‘মা, আমি সাদা চামড়ার মানুষের দেশে যেতে চাই।‘ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে। মাম ভাষাতেই উত্তর দিলেন মা, যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন, তবে বাবার শেষকৃত্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

প্রায় এক বছর পর, ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসরত কিছু আত্মীয়ের আশ্বাসে অ্যারোল্ডো পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রের পথে। পায়ে হেঁটে সিয়েরা মাদ্রে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে, মরুভূমি পেরিয়ে, সে পৌঁছায় সান ফ্রান্সিসকো বে এলাকায়। এই যাত্রা চার মাসেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল।

অ্যারোল্ডো এখন বলে, ‘বাবার মৃত্যু আমাকে বোঝাল, সময় এসেছে নিজেকে দাঁড় করানোর।’ তার পেছনে একটি ছবি, তার বাবা ঐতিহ্যবাহী টুপি, হাতে বোনা ম্যাজেন্টা শার্ট আর কালো কেপিক্সাই পরে আছেন, যেন ঠান্ডা ক্যালিফোর্নিয়ার রাতে পাহারা দিচ্ছেন তাকে।

অ্যারোল্ডো শুধু পোশাক বা ছবি আনেনি সঙ্গে, এনেছে তার মাতৃভাষা মাম—যার শিকড় প্রাচীন মায়া সভ্যতার গভীরে প্রোথিত। মধ্য আমেরিকার বহু প্রাচীন রাজ্য সেই ভাষায় কথা বলত। আজ, আধুনিক অভিবাসনের জোয়ারে সেই ভাষাই ঠাঁই পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী আদালত থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ, রেডিও ও সংবাদমাধ্যমে।

প্রাচীন ভাষার আধুনিক বিস্তার

মায়ান ভাষাগুলোর এই পুনর্জাগরণ হঠাৎ নয়। মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস ও এল সালভাদর থেকে আসা আদিবাসী অভিবাসীরা তাদের মাতৃভাষা সঙ্গে করে এনেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাম ও কিচে ভাষা এতটাই প্রচলিত হয়েছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আদালতে ব্যবহৃত শীর্ষ ভাষার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, লাতিন আমেরিকান অভিবাসীদের মধ্যে স্প্যানিশ ভাষার আধিপত্য থাকলেও আদিবাসী ভাষাগুলোর চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কারণ, স্প্যানিশ ভাষা অনেক আদিবাসীর কাছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষামাত্র। এদের মাতৃভাষা হলো মাম, কিচে বা কেকচির মতো প্রাচীন মায়ান ভাষা।

আইন ও সংবেদনশীলতার পরিবর্তন

২০২৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস হয়েছে। এই আইন রাজ্য সংস্থাগুলোকে লাতিন আমেরিকান অভিবাসীদের পছন্দের ভাষা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বাধ্য করে। এতে মাম ও কিচের মতো ভাষা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উদ্দেশ্য—এই অভিবাসীদের চাহিদা ভালোভাবে বোঝা এবং সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া উন্নত করা।

ভাষাবিদ টেসা স্কট বলেন, ‘শুধু অনুবাদকের ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, মায়ান অভিবাসীদের আলাদা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বাস্তবতা আছে, যা মেস্তিসো বা শ্বেতাঙ্গ লাতিনোদের থেকে আলাদা।’

গুয়াতেমালার মায়ান সম্প্রদায়, বিশেষ করে মামভাষীরা, শুধু ভাষাগত নয়, সামাজিক শ্রেণি বৈষম্য ও সহিংসতারও শিকার। তাদের অনেকেই নিজ দেশে লাঞ্ছিত ও অবহেলিত, যুক্তরাষ্ট্রে এসে নতুন পরিচয় ও সম্মান পাওয়ার চেষ্টা করেন।

ইতিহাসের ধারায় ভাষার রূপান্তর

স্প্যানিশরা ষোড়শ শতকে ইউকাটান উপদ্বীপে এসে মায়ান নগররাষ্ট্রগুলোর খোঁজ পায়। ওই সময়ে বিভিন্ন মায়ান শাসক স্প্যানিশদের সঙ্গে জোট বাঁধে পুরনো দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তির আশায়। স্প্যানিশরা ধর্মপ্রচারের জন্য স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। এভাবেই মায়ান ভাষাগুলো একদিকে দমনের শিকার হয়, আবার অন্যদিকে টিকে থাকার পথও খুঁজে পায়।

মায়ান হায়ারোগ্লিফিক পদ্ধতি, যা একসময় সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ব্যবহার করতেন, স্প্যানিশ ধর্মপ্রচারকরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে মৌখিক ভাষাগুলো টিকে যায় এবং লাতিন বর্ণমালায় রূপান্তরিত হয়ে নতুন জীবন পায়।

গবেষক শানেজ অর্টিজ বলেন, ‘ঔপনিবেশিক যুগে মায়ান ভাষাগুলোর ব্যবহার এতটাই বিস্তৃত ছিল যে উইল, রাজনৈতিক ঘোষণা, এমনকি আর্থিক হিসাবও এই ভাষায় লেখা হতো, যদিও সেগুলো লাতিন বর্ণমালায় লেখা হতো।‘

নতুন প্রজন্মের হাতে ভাষার পুনরুত্থান

আজকের দিনেও মায়ান ভাষাগুলোর প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বেড়ে চলেছে। চ’ কওয়োজ ও চিইকুলাল উউচবেন চ’ইবের মতো সংগঠনগুলো হায়ারোগ্লিফিক লিপি ব্যবহার করে ভাষার চর্চা ও শিক্ষায় ভূমিকা রাখছে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলগুলোতে এখন অনেক মায়ান ভাষাভাষী শিশু নিজেদের ভাষায় শিক্ষালাভ করছে। স্থানীয় রেডিওতেও সম্প্রচার হচ্ছে মাম ভাষায়।

এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ শুধু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস নয় বরং এক গভীর পরিচয় ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারের আন্দোলন।

মায়ান শব্দের বৈশ্বিক অভিযাত্রা

বিশ্ব ভাষায় অনেক মায়ান শব্দ ঢুকে পড়েছে, যেমন ‘সিগার’ শব্দটি এসেছে মায়ান ‘সিয়ার’ থেকে, যার অর্থ ছিল ধোঁয়া টানা। তামাকের ধোঁয়া টানার এই আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবহার পরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

একইভাবে ‘কাকাও’ শব্দটি, যার বীজ থেকে তৈরি হয় চকলেট, তা-ও মায়া সভ্যতার অবদান। ১৫৪৪ সালে মিশনারি ফ্রাই দে লাস কাসাস ইউরোপে এই বীজ নিয়ে যান এবং সেখান থেকে শুরু হয় চকলেটের জয়যাত্রা।

বর্তমানের বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ৩০টিরও বেশি মায়ান ভাষা জীবিত রয়েছে। এর মধ্যে কিচে, মাম ও কেকচির প্রতিটিরই প্রায় এক মিলিয়ন ভাষাভাষী আছে। অন্যদিকে চোলতি ও চিকোমুসেলতেক ভাষা বিলুপ্তির পথে।

মায়ান ভাষাগুলোর শিকড় একই প্রাচীন উৎস—প্রোটো-মায়ান ভাষা, যা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের আগেই প্রচলিত ছিল। তবুও আজকের ভাষাগুলো একে অপরের থেকে এতটাই পৃথক যে মাম ভাষাভাষীরা কিচে ভাষা বুঝতে পারেন না। এই ভাষাগত বৈচিত্র্য একদিকে ঐতিহ্যের প্রতীক, অন্যদিকে ভাষা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জও বটে।

অভিবাসনের প্রভাব ও সামাজিক পরিবর্তন

২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করতেন ৪ লক্ষ ১০ হাজার গুয়াতেমালান, যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ১৮ লক্ষ। এই জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মায়ান ভাষাভাষী। বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া ও ফ্লোরিডায় তাদের বসতি গড়ে উঠেছে।

এই অভিবাসনের ফলে সান হুয়ান আতিতানের মতো শহরগুলোর অর্থনীতি বদলে গেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আজ রেমিট্যান্সনির্ভর। এখন প্রায় প্রতি পাঁচজন বাসিন্দার একজন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী। তারা শুধু অর্থ পাঠাচ্ছেন না, পাঠাচ্ছেন ভাষা, সংস্কৃতি ও নতুন চেতনার সুরও।

মায়ান ভাষাগুলোর এই আধুনিক অভিযাত্রা শুধু একটি ভাষার নয়, একটি সংস্কৃতির টিকে থাকার গল্প। অ্যারোল্ডোর মতো হাজারো তরুণ নতুন দেশে পা রাখছেন প্রাচীন কণ্ঠস্বর বুকে নিয়ে। তাদের ভেতরেই গুঁজে আছে ইতিহাসের বহু স্তর—দমন, প্রতিরোধ, অভিযোজন এবং নবজন্মের।

যেখানে অনেক ভাষা বিশ্বায়নের তোড়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মায়ান ভাষাগুলো প্রমাণ করছে, যদি মানুষের হৃদয়ে ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকে, তবে কোনো কণ্ঠস্বরই হারিয়ে যায় না। সে ফিরে আসে, নতুন ভূমিতে, নতুন উচ্চারণে, নতুন পরিচয়ে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত