leadT1ad

ফ্রানৎস কাফকার জন্মদিন আজ

কাফকার পোকা হয়ে যাওয়া সেই গ্রেগর সামসা কি আমরাই

আজ বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক ফ্রানৎস কাফকার জন্মদিন। তাঁর বহুল আলোচিত উপাখ্যান ‘দ্য মেটামরফসিস’–এর প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা পোকায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। পুঁজিনির্ভর এই করপোরেট দুনিয়ায় আমরাও কি আজ পোকায় পরিণত হচ্ছি?

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৫১
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৫: ২৬
ফ্রানৎস কাফকা। স্ট্রিম গ্রাফিক

ফ্রানৎস কাফকার ‘দ্য মেটামরফসিস’ পড়ার অভিজ্ঞতা একেক পাঠকের কাছে একেক রকম। তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ একটির গল্প বলে শুরু করি। সাহিত্যজগতের আরেক মহারথী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় কাফকার এই কালজয়ী আখ্যান হাতে পান। প্রথম লাইন পড়েই তিনি এত বেশি চমকে যান যে প্রায় বিছানা থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে আগে কেউ বলেনি যে এভাবেও গল্প লেখা যায়।’ আমরা যাঁরা শ্রেণিকক্ষে এই নাতিদীর্ঘ আখ্যান পড়েছি, সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের মূল কাজ ছিল একে নানান তত্ত্বের আলোকে বিচার–বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবচ্ছেদ করে দেখা আর দেখানো। কিন্তু শুধু পড়ার জন্য পড়লেও ধরতে পারা যায় যে এক রাতে প্রটাগনিস্ট গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য ঘটনাটিই এই আখ্যানের মূল উপজীব্য নয়।

তাহলে শিরোনামের এই রূপান্তর আসলে কার রূপান্তর? সামসার মা-বাবা আর বোনের? যাদের কাছে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য গ্রেগর ধীরে ধীরে একটি অপ্রয়োজনীয় বোঝায় রূপান্তরিত হলো? মা-বাবা আর বোনের এই রূপান্তর কি তবে দেখিয়ে দিল পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তির কোনো দাম নেই, দাম আছে কেবল তার উপার্জিত অর্থের?

আচ্ছা, আমাদের জীবনও কি এমন নয়? আমাদের কাছেও কি আয়–রোজগারই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি?

খেয়াল করলে বোঝা যায়, সামসার জীবন পোকায় পরিণত হওয়ার আগেও খুব বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। ট্রাভেলিং সেলসম্যান হিসেবে সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করত, ছুটি বলে কিছু ছিল না তার। সকালে আরেকটু বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারাই তার একমাত্র বিলাসিতা। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসেবে তার সুস্থ যৌনজীবন ছিল না। ঘরে টানানো বিজ্ঞাপনে নারীর ছবির উল্লেখ থেকে পাঠক টের পান যে গ্রেগর সামসা সম্ভবত ছিল সেক্সুয়ালি ডিপ্রাইভড। বাড়ির সব খরচ বহন করত বলে যে সে আলাদা কোনো খাতির পেত তেমন আভাসও আমরা পাইনি। মা–বোন সকালে তাকে ডেকে তুলছিল অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। এদিকে সামসা নিজেও নিজের ভয়াবহ শারীরিক পরিবর্তনের কথা না ভেবে ভাবছিল অফিসের কথাই। একজন মানুষের কাছে তার আয়ের উৎস কতটা জরুরি হলে নিজের ব্যক্তিগত সব ক্ষতি তুচ্ছ হয়ে যায় যে সে নিজের চেহারা, শরীর আর আকার–আকৃতির পরিবর্তন নিয়ে না ভেবে ভাবতে থাকে চাকরির কথা?

কর্মক্ষেত্রের নানা ব্যস্ততা সামলে কতটা সরব থাকতে পারি আমরা! ছবি: আশরাফুল আলম
কর্মক্ষেত্রের নানা ব্যস্ততা সামলে কতটা সরব থাকতে পারি আমরা! ছবি: আশরাফুল আলম

আচ্ছা, আমাদের জীবনও কি এমন নয়? আমাদের কাছেও কি আয়–রোজগারই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি? বর্তমান বাংলাদেশে চাকরির বাজার এত খারাপ যে সরকারি–বেসরকারি যে কোনো একটা চাকরি পেলে তা ধরে রাখাই হয়ে যায় একজন তরুণের জীবনের মূল লক্ষ্য। কর্মক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের দুর্নীতি–অবিচার আর অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করতে হয়, কোনো রকম প্রতিবাদ করা যায় না। অনেক সময় নিজেকেও বাটপারির অংশে পরিণত করতে হয়। কখনো কখনো মেনে নিতে হয় মানবেতর পরিশ্রমের বোঝা, যাকে সাদা বাংলায় বলে ‘গাধার খাটুনি’। নারীদের মেনে নিতে হয় বিভিন্ন পর্যায়ের যৌন হেনস্তা কিংবা লৈঙ্গিক বৈষম্য। প্রতিবাদ করলেই চাকরিটা যাবে। মানুষ হয়ে জন্মেও আমরা অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মতো বেঁকেচুরে চলি, কেঁচোর মতো মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যাই, আরশোলার মতো অভিযোজিত হই। যেকোনো মূল্যে একটা চাকরি পাওয়া আর তা বাচিয়ে রাখার বাইরে আর কী–ই বা আছে আমাদের জীবনে?

কাফকা কেন নিজের রচনাগুলো নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন, তা–ও সম্ভবত এ থেকে বোঝা যায়। আমার ধারণা, মানুষের যে নিজেকে মানুষ হিসেবে দাবি করার গর্ব, শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে অহমিকা আর শ্লাঘা, কাফকার রচনাগুলো সেই মিথ্যা অহংকারের মূলে কুঠারাঘাত করে।

‘দ্য মেটামরফসিস’ লেখা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক এক শ দশ বছর আগে, ১৯১৫ সালে। কিন্তু আজকের সময়েও একই রকম প্রাসঙ্গিক এ আখ্যান। এ যুগের মানুষের জীবন, আমলাতন্ত্র আর করপোরেশনের যাঁতাকলে পিষ্ট শহুরে মানুষের মূল্যবোধ, ব্যক্তির তুলনায় উপার্জনের অধিক গুরুত্ব, মানুষকে শুধু উৎপাদনের উপাদান হিসেবে দেখার পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুই আজকের জামানায় খুব স্বাভাবিক, আমরা এসব মেনেও নিয়েছি আর মানিয়েও নিয়েছি এই ব্যবস্থার সঙ্গে।

ফ্রানৎস কাফকা (৩ জুলাই ১৮৮৩—৩ জুন ১৯২৪)। ছবি: সংগৃহীত
ফ্রানৎস কাফকা (৩ জুলাই ১৮৮৩—৩ জুন ১৯২৪)। ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্যের ভাষায় একটি প্রকরণ রয়েছে ‘কাফকায়েস্ক’, যা দিয়ে বোঝায় অদ্ভুতুড়ে, সুররিয়াল বা পরাবাস্তব হতাশা আর বিষণ্ন অবস্থা, যেমনটি কাফকার গল্পে পাওয়া যায়। লেখকের অন্য লেখায়ও এসব উপাদানের অভাব নেই। নিপীড়ক ব্যবস্থা আর মানবতার অশেষ অপমানকে বিভিন্ন রূপকে এবং অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির মোড়কে তুলে ধরেছিলেন তিনি। মানুষের প্রতি জীবন কতটা নির্দয় হতে পারে, সেই যন্ত্রণার বোধ তাঁর প্রায় সব লেখার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে।

‘দ্য মেটামরফসিস’ ছাড়াও বহু কালজয়ী রচনা আছে কাফকার। নিজের লেখাগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন তিনি। কিন্তু বন্ধু ম্যাক্স ব্রড তা না মেনে বিশ্ববাসীকে কাফকার অভূতপূর্ব লেখাগুলো পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলে তাঁর প্রতি আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব নিশ্চয়ই। তবে কাফকা কেন নিজের রচনাগুলো নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন, তা–ও সম্ভবত এ থেকে বোঝা যায়। আমার ধারণা, মানুষের যে নিজেকে মানুষ হিসেবে দাবি করার গর্ব, শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে অহমিকা আর শ্লাঘা, কাফকার রচনাগুলো সেই মিথ্যা অহংকারের মূলে কুঠারাঘাত করে। সম্ভবত কাফকা চাননি যে আমরাও এই নগ্ন সত্যের মুখোমুখি হই। আমরা কাফকার লেখার আয়নায় দেখে ফেলি আসলে গ্রেগর সামসার মতো আমরাও একেকটি অতিকায় কীট বৈ কিছু নই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; কথাসাহিত্যিক।

Ad 300x250

জুলাইয়ের প্রথম অংশ ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’, পরের কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার : মাহফুজ আলম

ঠাকুরগাঁওয়ে এনসিপির গাড়িতে বাসের ধাক্কা, হামলা

বিএনপির নেতা-কর্মীসহ গ্রেপ্তার চার, আসামি সহস্রাধিক

ভাইয়ের ওপর ‘প্রতিশোধ’ নিতে মুরাদনগরের ঘটনার ভিডিও অনলাইনে ছড়ান আরেক ভাই: র‍্যাব

মহাখালীর হোটেলে হামলার ভাইরাল ভিডিও থেকে রাজশাহীর ফোনালাপ, বিএনপিতে কয়েক হাজার বহিষ্কার

সম্পর্কিত