leadT1ad

অধ্যাপক ইউনূসের জাপান সফর: কী পাচ্ছে বাংলাদেশ

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৫, ১৯: ৫১

জাপানে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ৩১ মে শনিবার রাত ১০টা ৪০ নাগাদ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে বহনকারী বিমান অবতরণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ সফরে প্রায় ২০টি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তিনি। দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, চুক্তি স্বাক্ষর ও মতবিনিময় সভায় পূর্ণ এ সফর থেকে কী পাচ্ছে বাংলদেশ- 

সংস্কার কার্যক্রমে টোকিওর সমর্থন  

৩০ মে শুক্রবার সকালে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠক করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ বৈঠকে বাংলাদেশে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বিষয়ে সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে জাপান।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় নেতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অংশীদারত্বমূলক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দেন।  

বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, জাপানের অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স (ওএসএ) প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য পাঁচটি টহল নৌকা সরবরাহের অঙ্গীকার করেছে টোকিও। এছাড়া প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের চুক্তি বিষয়ে নীতিগত সম্মতিতেও পৌঁছায় দুই দেশ। 

এ বৈঠকে রোহিঙ্গাবিষয়ক পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান ইশিবা শিগেরু। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে অব্যাহত সহায়তার জন্য জাপান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান অধ্যাপক ইউনূস। বিশেষ করে বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি) উদ্যোগের আওতায় মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো প্রকল্পসহ বিভিন্ন উদ্যোগে জাপানের ধারাবাহিক সহায়তার কথা এ বৈঠকে উল্লেখ করেন তিনি। 

১০৬ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান সহায়তা 

বাংলাদেশের অর্থনৈতি সংস্কার ও জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে, রেল যোগাযোগ উন্নত করতে ও বৃত্তির জন্য ১০৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার সহায়তার কথা জানিয়েছে জাপান। এ বিষয়ক একটি ‘এক্সচেঞ্জ অব নোট’ স্বাক্ষরের কথাও যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়। শুক্রবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এ বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার ও জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন নীতি ঋণ হিসাবে ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার দেওয়া হবে। পাশাপাশি জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথকে ডুয়েল-গেজ ডাবল লাইনে উন্নীত করতে ৬৪ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং বৃত্তি খাতে ৪২ লাখ ডলার অনুদান দেওয়া হবে। 

৬ সমঝোতা স্মারক সই  

এ সফরে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতা সংক্রান্ত ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। ৩০ মে টোকিওতে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’ শীর্ষক এক সেমিনারের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে এসব স্মারক স্বাক্ষরিত হয় বলে জানায় বাসস। অধ্যাপক ইউনূস এই চুক্তিগুলোকে দুই দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের পথ উন্মুক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে উল্লেখ করেন। 

সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে—জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আট লাখ প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন সংক্রান্ত সমঝোতা, যার মোট ব্যয় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।    

দ্বিতীয় স্মারক স্বাক্ষরিত হয় অনোডা ইনক ও বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোন (বিএসইজেড)-এর মধ্যে। এর আওতায় গ্যাস মিটার তৈরির কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে জমি লিজ সংক্রান্ত চুক্তি হয়।  

তৃতীয় এমওইউ অনুযায়ী, বাংলাদেশ নেক্সিস কোম্পানি বিএসইজেড-এ একটি গার্মেন্টস সরঞ্জাম উৎপাদনকারী কারখানা স্থাপন করবে। 

গ্লাগিট, মুসাসি সিমিতিসু ইন্ডাস্ট্রি গ্লাফিট ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মধ্যে চতুর্থ সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর আওতায় ব্যাটারিচালিত বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেল উৎপাদনের কথা রয়েছে।

পঞ্চম সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, তথ্য নিরাপত্তা বিষয়ক একটি পাইলট প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশে দুই কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সাইফার কোর কোম্পানি লিমিটেড।  

ষষ্ঠ ও শেষ সমঝোতা স্মারকে জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) ও বিডা বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করতে একীভূত সিঙ্গেল উইন্ডো প্ল্যাটফর্ম (আইএসডব্লিউপি) উন্নয়নে কারিগরি সহায়তার ব্যাপারে সম্মত হয়।    

অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূস এমওইউ স্বাক্ষরকারী সব পক্ষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘চলুন, হাতে হাত মিলিয়ে এটি বাস্তবায়ন করি। এটি শুধু অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়। এটা মানুষের জীবন পরিবর্তনের বিষয়।’  

বছর শেষে হতে পারে ইপিএ চুক্তি

ইপিএ বা ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট হলো দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি চুক্তি। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্য সহজ করা, শুল্ক কমানো কিংবা উঠিয়ে দেওয়া, বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো এবং একে অপরের বাজারে প্রবেশ সহজ করা। 

টোকিওতে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে শিগেরু ইশিবা ও মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে ইপিএ সইয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ সম্পন্ন হতে পারে। 

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ইপিএ চুক্তি শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে গতি আনবে না, বরং বাংলাদেশকে একটি টেকসই রপ্তানিমুখী অর্থনীতিতে পরিণত করতেও সহায়ক হবে।’

শিগেরু ইশিবাও বাংলাদেশকে জাপানের ‘বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘ইপিএ চুক্তি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।’ 

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ জাপানের বাজারে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। তবে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের পর এই সুবিধা হারানোর সম্ভাবনা থাকায়, ইপিএ চুক্তিকে বাংলাদেশের জন্য একটি সময়োচিত ও কৌশলগত অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা 

বর্তমানে জাপানে শ্রমিক সংকট চলছে। তাই আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে দেশটি।

এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও জাপানে তাঁদের কর্মসংস্থান সহজ করবার উদ্দেশ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২৯ মে টোকিওর হিরাকাওচো চিয়োদা সিটিতে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত মানবসম্পদ সেমিনারে এটি স্বাক্ষরিত হয়। এ অনুষ্ঠানেই এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা জানায় জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা। 

জাপানি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি বাড়ছে

‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জাপানের সংসদীয় উপমন্ত্রী শিনজি তাকেউচি বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। বর্তমানে ৩০০টির বেশি জাপানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা এক দশক আগের তুলনায় প্রায় ৭৫% বেশি। বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে এ অনুষ্ঠানে আশা করেন তিনি।  

তা ছাড়া জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে, এমন জাপানি কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক ইউনূস বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আজ আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে আপনাদের সহায়তা আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। বাকি যাত্রাটি একসাথে আনন্দের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই…তাই জাপান সরকার এবং জাপানের ব্যবসায়ীদের সমর্থন আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।’

জেট্রো চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নোরিহিকো ইশিগুরো অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।   

Ad 300x250

সম্পর্কিত