leadT1ad

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উমামা ফাতেমার পদত্যাগ: কে কী বলছেন

সংগঠন ছাড়ার কারণ হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারাকে দায়ী করেন তিনি। পোস্টে লেখেন, ‘এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) নামক রাজনৈতিক দলটি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো করার দায়বদ্ধতা থেকে এই ব্যানার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই।

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ২০: ১৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। সংগৃহীত ছবি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন (বৈবিছাআ) ছাড়ার ঘোষণা দিলেন সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টের মাধ্যমে এ ঘোষণা দেন তিনি। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে দেওয়া এ পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছে গত পরশু। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো।’

সংগঠন ছাড়ার কারণ হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারাকে দায়ী করেন তিনি। পোস্টে লেখেন, ‘এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) নামক রাজনৈতিক দলটি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো করার দায়বদ্ধতা থেকে এই ব্যানার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপ্‌শন বাইরে এই ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়ত। তাই আমার উপর অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে আমি এই ব্যানার নিয়ে কাজ না করি।’

তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয়েছে দাবি করে উমামা বলেন, ‘যে মানুষগুলোর সাথে আমি পাশে দাঁড়ায়ে মিটিং করেছি, মিছিল করেছি, তারাই পরিকল্পতিভাবে জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে স্মিয়ার ক্যাম্পেইন (কুৎসা রটানো) চালায়। মানুষ বাইরে যত ভালো সাজার চেষ্টা করুক, ভিতর থেকে কতটা ছোটলোক হতে পারে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই ঐ সময়গুলাতে। এই সো কল্ড (তথাকথিত) সহযোদ্ধারা মানুষকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে, প্রয়োজন শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্তও লাগে না।’

আরও আগেই এই সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন জানিয়ে উমামা লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ব্যানারের থেকে সরাসরি পদত্যাগ না করলেও এই ব্যানারের সাথে কার্যত সম্পর্ক ছিন্ন করি গত এপ্রিল-মে মাসে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘এমপাওয়ারিং আওয়ার ফাইটারস’ নিয়ে কাজে মনোযোগ দিই। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল, সেসবে মনোযোগ দিই। অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পদত্যাগ করব। একটা পদত্যাগপত্র লিখে আর জমা দিইনি। পারি নাই আসলে। রাজনৈতিকভাবে ভাবলে পদত্যাগ করে আসাটা সবথেকে সহজ। কিন্তু আমি তো মানুষ, অনেক কঠিন, অভ্যুত্থানের কারণে পারি নাই। আমি এই প্ল্যাটফর্মে তো দেশ সংস্কার করতে আসছিলাম। কাদা ছোড়াছুড়ি করতে তো আসি নাই এখানে।’

মুখপাত্র হলেও সংগঠনের পেইজে তাঁর প্রবেশাধিকার ছিল না অভিযোগ করে উমামা লেখেন, ‘মুখপাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধীর পেইজের এক্সেস (প্রবেশাধিকার) থাকার কথা আমার কাছে। আমার দায়িত্ব হওয়ার কথা মিডিয়া হ্যান্ডলিং (সামলানো)। পেইজের এক্সেস দেয়া তো দূরের কথা, এই পেইজ থেকে মার্চ মাসে আমার বিরুদ্ধে পর্যন্ত পোস্ট হয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিতে চাইলে পেইজকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় আর নাইলে Silent treatment (নীরবতা অবলম্বন করা) সহ্য করতে হয়। দিনের পর দিন হেন কোনো নোংরামি নাই যা এরা করেনি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন রক্ষা করতে পারেনি দাবি করে উমামা বলেন, ‘অভ্যুত্থান যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, গোষ্ঠীস্বার্থে এই প্ল্যাটফর্ম একইভাবে বহু মানুষের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে। আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার আগে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরেই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্ররাই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার সাথে নোংরামি করেছে এতগুলা মাস, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে, তাদের আমি কখনো ক্ষমা করব না।’

এই পোস্টে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে দেওয়া ভোট প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন তিনি। পোস্টে লেখেন, ‘আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাউন্সিলে ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। যারা কাজ করতে চায় তারা বেশিরভাগ এই কাউন্সিলে প্রার্থীই হওয়ারই সুযোগ পায়নি। ভোটার খুব লিমিটেড (অল্প), যার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন সব। জুনিয়ররা ক্যাম্পাসে এসে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, যাতে ভোটটা দিতে যাই। স্বাভাবিকভাবেই আমি অপারগ ছিলাম। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার ১ মিনিট আগে আমি ভোটটা দিয়ে আসি। এতটুকুই যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি চেষ্টা করছি এখান থেকে ভালো কিছু হোক….তবে রাতেরবেলা ফলাফলের পর দেখলাম নির্বাচনে অংশ না নেয়া একজন এসে মেম্বার হয়ে গেছে কাউন্সিলের। এসব দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি

গত ২৫ জুন বুধবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। নতুন কমিটিতে সভাপতি পদে রশিদুল ইসলাম (রিফাত রশীদ) ও সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ ইনামুল হাসান (হাসান ইনাম) নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুখপাত্র পদে যথাক্রমে মুঈনুল ইসলাম ও সিনথিয়া জাহীন আয়েশা নির্বাচিত হয়েছেন।

রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল শেষে সন্ধ্যায় ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়।

রশিদুল পূর্বে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব ছিলেন। সম্প্রতি তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে, সাধারণ সম্পাদক ইনামুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেলের সম্পাদক ও জুলাই ম্যাসাকার আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাতা।

এই কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে উমামা ফাতেমা ভোট দিলেও পরে তা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

প্রতিক্রিয়া

উমামা ফাতেমার পদত্যাগ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সহ-সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইশা মালিহা স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমার মনে হয় উমামা ফাতেমার আরও আগে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তিনি এই প্ল্যাটফর্মটাকে সংস্কার করার চেষ্টা করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মকে সক্রিয় করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে একাডেমিক সংস্কারের চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তা করতে পারেননি। বরং প্ল্যাটফর্মটি বিতর্কিত হয়েছে নানা কারণে, সেটির দায় তাঁর ওপরও এসে পড়েছে। আমি মনে করি তাঁর পদত্যাগ যৌক্তিক।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বৈবিছাআ শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের একটি স্টুডেন্ট ফোর্স হিসেবে কাজ করবে বলে আমার ধারণা। পাশাপাশি সমন্বয়কদের দাপট আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। আশা থাকবে সেই দাপট নতুন দায়িত্বের অধীনে নিয়ন্ত্রিত হবে।’

উমামা ফাতেমার পদত্যাগের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদ্য নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ইনামুল হাসান স্ট্রিমকে বলেন, নির্বাচনের দিনও তিনি ভোট দিতে এসেছিলেন। অথচ এর তিন দিন পর তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হচ্ছে।

ইনামুল আরও বলেন, বৈবিছাআর নতুন কমিটি হওয়ার পর উমামা এমনিতেও আনুষ্ঠানিকভাবে মুখপাত্র পদে আর থাকেন না।

বর্তমানে বৈবিছাআর কাজ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, শহীদ ও আহতদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে বলেও জানান ইনামুল।

Ad 300x250

সম্পর্কিত