leadT1ad

ফেসবুকে সমালোচকদের ওপর আওয়ামীপন্থীদের ‘রিভিউ-বম্বিং’

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

আওয়ামী বট বাহিনীর রিউউ বম্বিং

ফেসবুকের ‘রিভিউ’ টুলকে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর হাতিয়ার করেছে আওয়ামীপন্থীরা। তাদের সমন্বিত নেটওয়ার্কে থাকা এক হাজারের বেশি অ্যাকাউন্ট থেকে সাংবাদকর্মী, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হচ্ছে। এতে পেজগুলোর রেটিং কমে যাচ্ছে, যেটিকে আওয়ামী লীগবিরোধী মত দমনে ‘রিভিউ-বম্বিং’ আখ্যায়িত করেছে ডিসমিসল্যাব।

স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ফ্যাক্টচেক এবং তথ্য গবেষণা প্ল্যাটফর্মটি মোট এক হাজার ১১৮ পেজের ৬২ হাজার ৫২৯টি রিভিউ বিশ্লেষণ করেছে। এতে দেখানো হয়েছে, এই নেটওয়ার্কের কার্যক্রম, কারা লক্ষ্যবস্তু ও কীভাবে একই ভাষা দ্রুত বহু জায়গায় ছড়ানো হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই নেটওয়ার্ক অন্তত ৭২১টি পেজকে লক্ষ্যবস্তু করে। এসব পেজের বিরুদ্ধে ‘ভুল তথ্য ছড়ানো’ থেকে ‘সন্ত্রাসবাদে’ জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। একই অ্যাকাউন্ট থেকে আবার বহু আওয়ামীপন্থি পেজে ইতিবাচক রিভিউ, এমনকি কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের পেজ ও দেশটির শাসক দল বিজেপির এক নেতার ফেসবুক প্রোফাইলে ইতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়েছে।

রিভিউ-বম্বিং হলো, একটি পেজের রিভিউ বিভাগে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচুর নেতিবাচক মন্তব্য বা রেটিং দেওয়া, যাতে পেজটির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিসমিসল্যাব বলছে, তারা স্পষ্ট সমন্বয়ের প্রমাণ পেয়েছে। অনেক রিভিউ অল্প সময়ের ব্যবধানে আসে এবং একই শব্দচয়নের। যেমন: ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’ সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আক্রমণের শিকার হয়। গত জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের ছবি প্রকাশ করায় একই আক্রমণের শিকার হয় দৃক। ডিমমিসল্যাব নিজেও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেত্রী ডা. তাসনিম জারার অনলাইন হয়রানি নিয়ে প্রতিবেদন করে একই হামলার শিকার হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ধরন দেখা যায়, ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে বিভিন্ন পেজে একই মন্তব্য ও লেখা ব্যবহার করা হয়েছে।

গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, এমন রিভিউ জনমতকে বিভ্রান্ত করে। এক সম্পাদক এই তৎপরতাকে ‘অনলাইন মব’ বলেছেন। এই মব শুরুতেই ঘটনা ও প্রেক্ষাপটকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং টার্গেট করা পেজটিকে বিশ্বস্ত নয় বলে তুলে ধরে।

সংবাদমাধ্যম বেশি আক্রান্ত হলেও, বাদ পড়েনি অন্যরা। প্রকাশনা সংস্থা, অনলাইন বইয়ের দোকান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, এমনকি কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানও এই নেটওয়ার্কের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি, পুলিশ এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হয়েছে। রাজনীতিকদের মধ্যে ববি হাজ্জাজ, রাশেদ খাঁন ও মাহফুজ আলম রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এবং পাকিস্তান হাইকমিশনের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ‘সন্ত্রাসবাদ প্রচার’ করে বলে রিভিউ দেওয়া হয়েছে।

কারা এসব পোস্ট করেন

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে আসা ৬০টি অ্যাকাউন্টের বেশির ভাগই বেনামে রাজনৈতিক উপাধি ব্যবহার করেছে, কখনও তা ব্যঙ্গাত্মকভাবে। ১৯টি অ্যাকাউন্ট খাবার বা মসলা জাতীয় পণ্যের নামে। অনেক অ্যাকাউন্ট আবার শেখ রাসেল, নীল, নীরা নীরা ও হায়দার আহমাদ এর মতো নাম ব্যবহার করেছে। এগুলো সবই ভুয়া।

নেটওয়ার্কটি কতটা বিস্তৃত, তা বুঝতে ডিসমিসল্যাব নেটওয়ার্কটির মধ্যে সমন্বয়ের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, যে মন্তব্যগুলো ১০ বার বা তার বেশি এসেছে, কেবল সেগুলো রেখে বাকিগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে এক হাজার ১৯টি অ্যাকাউন্ট শনাক্ত হয়, যারা হুবহু একই বার্তা কপি-পেস্ট করে। এত বড় সংখ্যক পোস্ট স্বতঃস্ফূর্তভাবে হওয়ার কথা নয়।

মোট ১৩ হাজারের বেশি রিভিউ মন্তব্য বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ ছিল আওয়ামী লীগপন্থি বার্তা। প্রায় পাঁচটির মধ্যে চারটি মন্তব্য ছিল আক্রমণাত্মক। প্রায় ১৬ শতাংশ মন্তব্য দলঘনিষ্ঠ বা দলসমর্থিত পেজের প্রশংসা। ‘এই পেজটি ভুল তথ্য ছড়ায় এবং সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ দেয়। মেটার উচিৎ এটি সরিয়ে ফেলা’– এই মন্তব্য ৯৩০ বার দেখা গেছে। ২১৫ রিভিউয়ার চলতি বছরের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে হুবহু এই মন্তব্য পোস্ট করেন।

ভুক্তভোগী ঢাকা স্ট্রিম, কীভাবে কাজ করে নেটওয়ার্ক

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা স্ট্রিমেরর ওপর হামলা এই নেটওয়ার্কের কার্যপ্রণালীর একটি স্পষ্ট উদাহরণ। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্ট্রিম শেখ হাসিনার এক হিন্দু পরিবারের জমি জোরপূর্বক কেনার অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর আধা ঘণ্টার মধ্যেই (বিকেল ৫টা ৫৫ থেকে ৬টা ৩৬) ৩০টি নেতিবাচক রিভিউ পায় ঢাকা স্ট্রিমের ফেসবুক পেজ। সব রিভিউ একই ভাষা ও ভঙ্গিতে এবং ধারাবাহিকভাবে করা।

ঢাকা স্ট্রিমের সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের ডেপুটি ম্যানেজার উচ্ছ্বাস খান বলেন, ‘এটি ছিল সরাসরি অনলাইন হয়রানি।’ তাঁর ভাষায়, স্ট্রিমের পেজের বিরুদ্ধে শুধু ‘ভুয়া সংবাদ’ প্রচারের অভিযোগই করা হয়নি, বরং কর্মীদের ব্যক্তিগত ছবি ও পরিবার-সম্পর্কিত তথ্য নেতিবাচক রিভিউয়ের সঙ্গে ছড়ানো হয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের ছবি প্রকাশ করায় স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দৃকও আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও একই ধরন দেখা যায়, ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে একই মন্তব্য, সমন্বিত সময়ে পোস্ট এবং বিভিন্ন পেজে হুবহু ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ডা. তাসনিম জারার অনলাইন হয়রানি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ডিসমিসল্যাবও আক্রমণের শিকার হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একই ধাঁচের মন্তব্যের ঢল নামে। দুই ঘণ্টায় ৪৮টি রিভিউ আসে, যার মধ্যে বেশি সংখ্যক #StopPropaganda বা #ProtectHistory হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে। তিন দিনে মোট ৬০টি প্রোফাইল নেতিবাচক রিভিউ দেয়। কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যায়, এগুলো ছিল মাত্র ২৩টি মূল বার্তা, যা বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে। পরে দেখা যায়, একই রকম ২৩টি বার্তা ৩১৫টি পেজে মোট এক হাজার ৪৭৩ বার ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচও এমন আক্রমণের শিকার হয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুমন রহমান কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, নেটওয়ার্কটির মূল উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট পেজ বিশ্বাসযোগ্য নয়, এটি প্রতিষ্ঠিত করা। প্রথম ধারণা (ফার্স্ট ইমপ্রেশন) খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক ব্যবহারকারী সত্যতা যাচাই ছাড়াই মত গঠন করেন।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) সামাজিকবিজ্ঞান স্কুলের ডিন সুমন রহমান সতর্ক করে বলেন, একই ধরনের নেতিবাচক রিভিউয়ের ঢল সহজেই ‘অনলাইন মব’ তৈরি করতে পারে। সামাজিকমাধ্যমের প্রপাগান্ডা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ও সচেতনতা না থাকায় অনেকেই যাচাই-বাছাই ছাড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান।

Ad 300x250

সম্পর্কিত