leadT1ad

দুই কিস্তি ঋণছাড়ের পর বাংলাদেশ নিয়ে নতুন বার্তা আইএমএফের

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ১৮: ৩৪
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ২০: ৪৩
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফ এর বার্তা। স্ট্রিম গ্রাফিক

দীর্ঘ ৬ মাস পর অবশেষে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩৭ কোটি ডলার ছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। গত সোমবার (২৩ জুন) ওয়াশিংটনে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সেই সঙ্গে সভায় বাংলাদেশের অনুরোধে এই ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাড়তি আরও ৮০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে সংস্থাটি। ফলে বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াল ৫৫০ কোটি ডলার।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে শুরু হয় এই ঋণ কর্মসূচি। প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পাওয়া যায় ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তিতে আসে ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। প্রথম ৩ কিস্তিতে মোট পাওয়া যায় ২৩১ কোটি ডলার।

যে কারণে আটকে ছিল কিস্তি

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কিস্তির অর্থ ছাড় হওয়ার কথা থাকলেও ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র তুষারঝড়ের কারণে আইএমএফের কার্যক্রমে বিলম্ব ঘটে। এরপর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে বোর্ড সভা হলেও বাংলাদেশের বিষয়টি আলোচনায় জায়গা পায়নি।

কিন্তু এই জট তৈরি হয় মূলত কয়েকটি শর্ত পূরণ না হওয়ায়। এগুলো হলো রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া ও বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করা। এরমধ্যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আইএমএফ কিছুটা ছাড় দিতে চাইলেও ডলার বিনিময় হার ইস্যুতে তারা ছিল কঠোর।

চলতি বছরের এপ্রিলে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঋণের শর্ত পূরণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে। দুই সপ্তাহের পর্যালোচনা শেষে তারা তখন কিছু জানায়নি। এরপর এপ্রিলের শেষ দিকে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক–আইএমএফ বসন্তকালীন সভায় বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হয়। তবু জট কাটেনি।

মে মাসের শুরুতে একাধিক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এতে অংশ নেন। ধারাবাহিক আলোচনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি হয় বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারমুখী করতে। গত মাসের ১৪ মে গভর্নর মনসুর জানান, আইএমএফ কিস্তি ছাড়ে মৌখিকভাবে সম্মত হয়েছে। দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর মে মাসেই খুলে যায় ঋণছাড়ের পথ।

সরকার শুরুতে মুদ্রার বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নিয়ে আগ্রহী না থাকলেও শেষ পর্যন্ত এই শর্ত মেনে নেওয়ার পরেই কিস্তিছাড়ের জট খুলে যায়।

কত দাঁড়াল রিজার্ভ

আইএমএফ থেকে দুই কিস্তির ঋণের টাকা আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার পার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দিন শেষে দেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভে আইএমএফের ১৩৭ কোটি ডলার যোগ হয়েছে।

তবে আইএমএফ যেভাবে রিজার্ভ হিসাব করে, সেই নিয়ম (বিপিএম-৬) অনুযায়ী এখন রিজার্ভ ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। এদিকে বর্তমানে দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ ধরলে এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে একটি দেশের হাতে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকাকে ‘সুরক্ষিত অবস্থান’ বলে ধরা হয়। এই হিসাবে এখন বাংলাদেশের রিজার্ভের অবস্থা তুলনামূলক ভালো।

এক মাস আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। তখনকার রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল না। আইএমএফের দুই কিস্তির ঋণ এবং সাম্প্রতিক কিছু রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে এই অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে জানা গেছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস

আইএমএফের বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির কয়েকটি সূচক নিয়ে কিছু পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। তাদের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে উঠবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।

মূল্যস্ফীতি (দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি) নিয়েও পূর্বাভাস সংশোধন করেছে আইএমএফ। তারা মনে করছে, চলতি অর্থবছরের শেষে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে পরের অর্থবছরে তা কিছুটা কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়ন ও পরামর্শ

চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণছাড়ের অনুমোদনের পর আইএমএফ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ২০২৪ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত গঠিত হওয়ায় দেশে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। এর ফলে ধীরে ধীরে অর্থনীতিও স্থিতিশীলতার দিকে ফিরছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো পুরো কাটেনি।

আইএমএফ মনে করে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখন সরকারের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো দেশের বাইরের অর্থনৈতিক চাপ সামলানো ও মূল্যস্ফীতি কমানো। এক্ষেত্রে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করা এবং ২০২৬ সালের বাজেটে কর বৃদ্ধির উদ্যোগকে তারা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখেছে। এ ছাড়া কড়াকড়ি আর্থিক নীতি, নমনীয় বিনিময় হার ও করভিত্তিক রাজস্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।

আইএমএফ আরও বলেছে, কর আদায় বাড়ানো এবং ভর্তুকি কমিয়ে ব্যয় বাঁচানো গেলে সামাজিক, উন্নয়ন ও জলবায়ু খাতে বেশি অর্থ খরচ করা সম্ভব হবে। ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জন্য নতুন আইন করে ব্যাংক খাতের সংস্কার ও ব্যাংক পুনর্গঠনে জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে তারা মনে করে। যেমন রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনা, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো, সুশাসন জোরদার করা এবং পরিসংখ্যান ও তথ্যের মান উন্নত করা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত