leadT1ad

১৫ বছর লড়াইয়ের পুরস্কার পেল নারী ফুটবল দল

অর্থাভাবে খেলতে না পারা দলটিই আজ এশিয়ান কাপের মূলপর্বে

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৩৯
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৭: ০৬
অর্থাভাবে খেলতে না পারা দলটিই আজ এশিয়ান কাপের মূলপর্বে। স্ট্রিম গ্রাফিক

মিয়ানমারের শহর থিঙ্গাঙ্গুন, সেখানকার স্টেডিয়ামের নাম থুন্না, আর স্টেডিয়ামের ঘাসে ভিজে আছে এক অদেখা কান্না।

ম্যাচ শেষে ঋতুপর্ণা চাকমা হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন মাঠে। তিনি মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলছিলেন। সেই কান্না হয়তো আনন্দের, আবার হয়তো এক চাপা আক্ষেপের। ঠিক দুই বছর আগে তাঁদের এই মাটিতে খেলার কথা ছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে গোটা দলটাই যেতে পারেনি সেখানে। সেই অপূর্ণতা আজ যেন রূপ নিয়েছে পূর্ণতায়।

অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতা

২০১০ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখন তেমন একটা ভিড় নেই। পুরুষ ফুটবলের প্রতি দর্শকরা বেশি আগ্রহী ছিলেন। নারী ফুটবল তখনও যেন অনেকটা ‘অজানা অধ্যায়’। কিন্তু সেদিন ইতিহাসের পাতা উল্টে দিয়েছিল কিছু কিশোরী। নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে যাঁদের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল সেদিন ।

মাঠে অভিজ্ঞতার অভাব স্পষ্ট ছিল, দ্বিধাগ্রস্ত শরীরী ভাষা আর অনভিজ্ঞতার ছাপ। তবুও সেদিন কিছু একটা শুরু হয়েছিল—যা ছিল ভবিষ্যতের এক দুর্দান্ত পথচলার সূচনা। প্রথম ম্যাচে পরাজয় এলেও আত্মবিশ্বাস হারায়নি মেয়েরা। সেই হারের ভেতরেই ছিল এক আশাবাদের বীজ, যা পরবর্তী সময়ে গড়ে তুলেছিল এক লড়াকু দল।

বছরের পর বছর তাঁরা ক্যাম্পে থেকেছে, ছেড়েছে পরিবারের সান্নিধ্য। তাঁদের প্রাপ্তি ছিল সীমিত। ছিল না এক জোড়া ভালো বুট, ছিল না নিরাপদ মাঠ বা পর্যাপ্ত পুষ্টির নিরাপত্তা। কিন্তু ফুটবলই ছিল তাঁদের পরিচয় ও ভবিষ্যতের ভাষা।

এর আগে দুইবার এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে খেলে একটি ম্যাচেও জয় পায়নি বাংলাদেশ। তবে এবার সেই ‘অপূর্ণ’ অভিজ্ঞতা আর দীর্ঘ প্রস্তুতির ফল মিলছে হাতে-নাতে। দুটো ম্যাচে জিতে ইতিহাস গড়ে দলটি—প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নিশ্চিত করেছে জায়গা।

বিশ্বকাপের টিকিটও মিলতে পারে ঋতুপর্ণাদের! ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বকাপের টিকিটও মিলতে পারে ঋতুপর্ণাদের! ছবি: সংগৃহীত

যেখান থেকে ফিরতে হয়েছিল, সেখানেই গড়া ইতিহাস

২০২৩ সাল, অলিম্পিক বাছাইপর্বে অংশ নিতে প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ নারী দল। অনুশীলন প্রায় শেষ, খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুতিও চূড়ান্ত। এমন সময় খবর এল—সফর বাতিল। কারণ অার্থিক সংকট।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন জানায়, বাজেট না থাকায় দল পাঠানো সম্ভব নয়।

এই খবর শুনে হতবাক হয়ে যান ক্রীড়াপ্রেমীরা। প্রশ্ন ওঠে, যে নারী দল দক্ষিণ এশিয়ায় সাফল্য এনে দিয়েছে, সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাদেরই কিনা আন্তর্জাতিক খেলায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না?
এরপর অনেক সমালোচনা হয়, কিন্তু খেলোয়াড়রা মুখ খোলেন না। তাঁরা অনুশীলন চালিয়ে যান নতুন কোনো সুযোগের অপেক্ষায়।

ঠিক দুই বছর পর আবার সেই মিয়ানমারেই ফিরে যায় দল। তবে এবার অলিম্পিক নয়, এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব। এবার আর তাঁরা ফেরেনি শূন্য হাতে। দুই ম্যাচেই দুর্দান্ত জয় তুলে নিয়ে বাংলাদেশ নারী দল জায়গা করে নেয় এশিয়ান কাপের মূলপর্বে। অর্থাভাবে যেখানে যেতে পারেনি তাঁরা, ঠিক সেখান থেকেই ফিরল মাথা উঁচু করে।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এই সাফল্যের পেছনে আছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর আত্মত্যাগ। জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা দীর্ঘ সময় ক্যাম্পে থেকেছেন, একই রুটিনে কঠোর অনুশীলন করেছেন। সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসবেও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো হয়নি অনেকের। চোখে জল নিয়েও তারা গেছেন মাঠে, কারণ দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন এত সহজে ভুলে যাবার নয়।

এই মেয়েদের অধিকাংশেরই ফুটবলের বাইরে কোনো নির্ভরযোগ্য উপার্জনের পথ নেই। ভালো মাঠ, মানসম্পন্ন খাবার বা একজোড়া ভালো বুট—সব সময় ছিল না। তবু তাঁরা থামেনি। ফুটবল তাঁদের কাছে শুধু খেলা নয়, এটি তাঁদের অস্তিত্বের লড়াই।

দক্ষিণ-এশিয়া নারী ফুটবলে ভারত ও নেপালের ছিল দীর্ঘদিনের একচেটিয়া আধিপত্য। সেই জায়গা থেকেই ২০২২ ও ২০২৪ আসরে টানা দুটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বাংলাদেশ দেখিয়েছে—তাঁরা শুধু প্রতিযোগী নয়, এখন সেরা হওয়ার দাবিদারও।

বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে জয় ছিল এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। সেই আত্মবিশ্বাসই ছিল তাঁদের এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে সফলতার ভিত্তি।

এই সাফল্য শুধু মাঠের গল্প নয়—এটি দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে ‘আন্ডারডগ’ থেকে শীর্ষে উঠে আসার এক দুর্দান্ত অনুপ্রেরণার গল্প।

নারীদের ফুটবলে নতুন পথপ্রদর্শক- বাটলার

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কোচ পিটার বাটলার দায়িত্ব নেয়ার পর বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরোনো কৌশল আর পরিকল্পনায় সাফল্য আসবে না। তাই তিনি এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। জাতীয় দলের অভিজ্ঞ কিছু খেলোয়াড়কে বাদ দিয়ে তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সুযোগ দেন। যদিও শুরুতে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। বাটলার শুধু খেলোয়াড়দের শারীরিক ফিটনেস বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা শেখাননি, বরং তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, পেশাদারিত্ব এবং টিম স্পিরিট গড়ে তোলায় গুরুত্ব দিয়েছেন। কঠোর অনুশীলন এবং মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি দলের পরিবেশ বদলে দিয়েছেন এবং খেলোয়াড়দের মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করেছেন।

২০২৪ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর বাটলার বলেন, ‘উল্লাসে বেশি ভাসা ঠিক হবে না। আমাদের লক্ষ্য বিশ্বমঞ্চে খেলা এবং সাফল্য অর্জন করা।’ তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি দলের উচ্চাভিলাষকে প্রতিফলিত করে। তাঁর দায়িত্বকালে নারী দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হয়েছে। তরুণ খেলোয়াড়দের দলে অন্তর্ভুক্তির ফলে দল হয়েছে গতিশীল ও আত্মবিশ্বাসী, যা পরবর্তীতে বড় মঞ্চে সফল হওয়ার ভিত্তি তৈরি করেছে। পিটার বাটলারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল শুধু ফুটবল কৌশল নয়, মানসিক শক্তিরও একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।

নারী দল এগোচ্ছে, পুরুষ দল থমকে

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ইতিহাস গড়েছে। প্রথমবারের মতো তাঁরা এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। এটি বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে একটি বড় সাফল্য। বাছাইপর্বে দুটি ম্যাচে জয় নিয়ে ‘সি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে ২০২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য নারী এশিয়ান কাপের মূলপর্ব নিশ্চিত করেছে তাঁরা। এই টুর্নামেন্ট নারী বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হিসেবেও কাজ করবে। ফলে বাংলাদেশের মেয়েরা সরাসরি ২০২৭ সালের নারী বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে।

২০২৬ সালের এশিয়ান কাপ মূলপর্বে মোট ১২টি দল অংশ নেবে, যাঁরা তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে। গ্রুপ পর্ব থেকে তিনটি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দল এবং তৃতীয় স্থান অধিকারী সেরা দুই দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠবে। এরপর সেমিফাইনাল ও ফাইনালের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হবে। এশিয়া অঞ্চলের ৬টি দল সরাসরি ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে জায়গা পাবে এবং অতিরিক্ত দুটি দল আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফ থেকে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে।

এশিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা আটটি দল ২০২৮ সালের অলিম্পিক বাছাইপর্বে খেলবে। দলগুলো দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে লড়বে এবং দুই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল সুযোগ পাবে সরাসরি লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকের নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল দল ১৯৮০ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপেই তাঁদের একমাত্র মূলপর্ব খেলার সুযোগ পেয়েছিল। এরপর থেকে বারবার বাছাইপর্বে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও তারা মূলপর্বে উঠতে পারেনি। ২০২৫ সালের বাছাইপর্বেও প্রথম দুই ম্যাচ হারের ফলে পুরুষ দল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়েছে। দলের কোচ পরিবর্তন, খেলোয়াড় নির্বাচনে বিতর্ক এবং দেশের ফুটবল লীগের অস্থিতিশীলতার কারণে পুরুষ দলের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

সীমিত রিসোর্স, কম ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল দৃঢ় সংকল্প ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এশিয়ান কাপের মূলপর্ব নিশ্চিত করেছে। এই ভিন্নতা শুধু খেলাধুলার পার্থক্য নয়, দেশের ফুটবল ব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বশীলতার ওপরও বড় প্রশ্ন তুলেছে। যেখানে পরিকল্পিত কৌশল ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে নারী দলের উন্নতি হয়েছে, সেখানে পুরুষ দলের ব্যর্থতা যেন কাঠামোগত দুর্বলতা ও অনিয়মেরই প্রতিফলন।

এই সাফল্য বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে শুধু আঞ্চলিক নয়, এশিয়ার মঞ্চেও পরিচিতি এনে দিয়েছে। তাঁরা ভবিষ্যতে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এটি দেশের ক্রীড়াজগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ইঙ্গিত।

Ad 300x250

ভাইয়ের ওপর ‘প্রতিশোধ’নিতে মুরাদনগরের ঘটনার ভিডিও অনলাইনে ছড়ান আরেক ভাই: র‍্যাব

বনানীর হোটেলে হামলার ভাইরাল ভিডিও থেকে রাজশাহীর ফোনালাপ, বিএনপিতে কয়েক হাজার বহিষ্কার

এম এম আকাশদের ‘প্রতারণা’র বয়ান ও পরাজয়বাদী চিন্তার মোকাবিলা

ফ্যাশন–দুনিয়ায় যেভাবে এসেছিল বিকিনি

যেভাবে দালাই লামার পুনর্জন্ম ঘটে

সম্পর্কিত