প্রতিবেদনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার কারণ হিসেবে বিনিয়োগে স্থবিরতার কথা বলা হয়েছে। পিপিআরসি বলছে, নতুন কারখানা বা প্রকল্প না থাকায় নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ বাঁচাতে কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে মানুষের আয় কমছে, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য বাড়ছে।
মো. ইসতিয়াক
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নানা অর্থনৈতিক সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকৃত পরিবর্তন বেশি দেখা গেছে ব্যাংকিং খাতে। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে, রিজার্ভ বেড়েছে, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়নি। কিছু ব্যাংকিং অনিয়ম দূর করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তবু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র তেমন উজ্জ্বল নয়। বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবৃদ্ধির ধাক্কা চাকরি, আয় ও জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার কারণ হিসেবে বিনিয়োগে স্থবিরতার কথা বলা হয়েছে। পিপিআরসি বলছে, নতুন কারখানা বা প্রকল্প না থাকায় নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ বাঁচাতে কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে মানুষের আয় কমছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং দারিদ্র্য বাড়ছে। শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে—অনেক কোম্পানি লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
ডলারের স্থিতিশীলতায় আমদানি ব্যয় কমেছে, যা ওষুধ, কাঁচামাল ও জ্বালানির সরবরাহে স্বস্তি দিয়েছে। মূল্যস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এই পরিবর্তনগুলো মূলত ব্যবস্থাপনাগত; অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার এখনো কার্যকর হয়নি।
বিনিয়োগই প্রবৃদ্ধি ও চাকরির প্রধান চালিকাশক্তি। বিনিয়োগ কমলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও ভোগব্যয়—সবই কমে যায়। এখন সেই প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজার ও শেয়ারবাজারে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলার দুরবস্থা ও ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতির কারণে অনেকেই শ্রমবাজার থেকে সরে যাচ্ছেন।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। গাজীপুরে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের অনেকেই এখন জীবিকার জন্য ফুটপাতে বা বাজারে সবজি বিক্রি করছেন।
প্রবৃদ্ধি কমে গেলে কী ঘটে
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জাওয়াদুল কারিম বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানে দেশের মোট উৎপাদন ও আয়ের হার। প্রবৃদ্ধি বাড়লে জীবনমান উন্নত হয়, আর কমে গেলে সমস্যা তৈরি হয়।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। কোভিড-১৯ ছাড়া গত দুই দশকে এত কম প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
কারিমের মতে, প্রবৃদ্ধিই অর্থনীতির প্রাণ। প্রবৃদ্ধি বাড়লে নতুন কারখানা গড়ে ওঠে, ব্যবসা বাড়ে, চাকরি তৈরি হয়, আয় ও ভোগব্যয় বেড়ে অর্থনীতি ইতিবাচক চক্রে প্রবেশ করে।
কিন্তু প্রবৃদ্ধি কমে গেলে চাকরির সুযোগ সবার আগে সংকুচিত হয়। বিনিয়োগ না থাকায় নতুন শিল্প গড়ে উঠে না। প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ বন্ধ করে বা ছাঁটাই করে। এতে আয় কমে এবং মূল্যস্ফীতির চাপে বাস্তব আয় আরও কমে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিনমজুরেরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন, আর ধনী শ্রেণি তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে বা লাভবান হয়। ফলে আয়-বৈষম্য বেড়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদে পরিবারগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমায়। ভোগ কমলে বিনিয়োগও কমে। তখন অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে—আয় কমে, বৈষম্য বাড়ে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির ধাক্কা শুধু পরিসংখ্যান নয়; এটি চাকরি, আয় ও জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে এই সংকটকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই নীতি নেওয়ার সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।’
দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান
বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক জরিপ দেখিয়েছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ পূর্ণাঙ্গ চাকরিতে যুক্ত নন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করলে একজনকে কর্মজীবী ধরা হয়। কিন্তু অনেকেই সপ্তাহে পূর্ণ ৪০ ঘণ্টা কাজ পাচ্ছেন না। চারজন কর্মজীবীর একজন (৩৮%) আন্ডারএমপ্লয়েড বা ছদ্মবেকার।
নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ আরও কম। কর্মক্ষম বয়সী নারীদের মাত্র ২৬% কাজ করছেন। প্রায় অর্ধেক কর্মজীবী স্বনিয়োজিত, অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। ফলে আয়ের অস্থিরতার কারণে তাঁরা সহজেই দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ছেন।
গত তিন বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। মজুরি বৃদ্ধি প্রায়শই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে বাস্তব আয় কমে যাওয়ার ধারা চলছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কিছুটা অবনতি হলেও, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখনও সীমিত।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হতে পারে। ২০২৫ সালের মে মাসে দেশের দারিদ্র্য হার প্রায় ২৮%। তুলনামূলকভাবে গরিব পরিবারগুলো আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করছে, মধ্যবিত্তরাও খাদ্য খাতে বেশি ব্যয় করছেন।
পিপিআরসির চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখন কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।’
কমছে আয়, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যের চাপ
গত তিন বছরে দেশে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে ছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় হার ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কমলেও জুলাইয়ে আবার বেড়ে তা ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ, ৮ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগ ও অর্থপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
ঢাবির অধ্যাপক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘পাশের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থা স্পষ্ট হয়। শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি নেই। পাকিস্তানে ৪ শতাংশ এবং ভারতে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। নেপালে ২ দশমিক ৭২ শতাংশ। সেই তুলনায় বাংলাদেশে এখনো ৮ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে, যা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টদায়ক।’
খাদ্যপণ্যের দাম পরিস্থিতি আরও কঠিন করেছে। শীতের সময় থেকে চালের দাম বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যতালিকায় ভাতের অংশ বেশি থাকায় তাঁরা বেশি প্রভাব অনুভব করছেন। বর্ষায় সবজির দাম বেড়েছে। সবজি কম খাওয়ায় ডিমের দামও বেড়েছে।
খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে জানালেও মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন নেই। আয় কমে খরচের ক্ষমতা সীমিত হচ্ছে। ফলে ভোগক্ষমতা কমছে, বাজারে চাহিদা কমছে। মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনিয়োগে খরচ কমাচ্ছেন। তাই সামান্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস হলেও সুফল সীমিত।’
মূলধনি পণ্য আমদানি কমেছে, শিল্প স্থবির
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে মূলধনি পণ্যের আমদানি ১০ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। যন্ত্রপাতি সবচেয়ে বেশি—১৯ দশমিক ১ শতাংশ কম। অন্যান্য মূলধনি পণ্য ৫ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। শিল্প ও নির্মাণে প্রয়োজনীয় ক্লিংকারও ৭ শতাংশ কম। ফলে শিল্প আধুনিকায়ন ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
চালের আমদানি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে—২০২৩-২৪ সালে, ২ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪-২৫ সালে ৬৮ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলারে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শিল্প ও উৎপাদনে মূলধনি পণ্যের ঘাটতি উদ্বেগজনক।
বিদেশি বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে, কিন্তু অধিকাংশই পুনর্বিনিয়োগ। নতুন বিনিয়োগ তেমন নেই। আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতি আপাতত স্থিতিশীল, কিন্তু নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি চাপ দিচ্ছে।’
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূলধনি পণ্যের আমদানি নিশ্চিত করা।
বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি আপাতত একধরনের স্থিতিশীলতায় আছে, কিন্তু তা মূলত নিম্নমুখী। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় আঘাত পড়ছে—আয় কমছে, দাম বাড়ছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে।
নীতি নির্ধারকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং শ্রমবাজারে নতুন চাকরি তৈরি করা।
এই তিনটি না হলে সামষ্টিক সূচকে সামান্য উন্নতি হলেও মানুষের জীবনমান উন্নত হবে না। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নানা অর্থনৈতিক সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকৃত পরিবর্তন বেশি দেখা গেছে ব্যাংকিং খাতে। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে, রিজার্ভ বেড়েছে, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়নি। কিছু ব্যাংকিং অনিয়ম দূর করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তবু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র তেমন উজ্জ্বল নয়। বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবৃদ্ধির ধাক্কা চাকরি, আয় ও জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার কারণ হিসেবে বিনিয়োগে স্থবিরতার কথা বলা হয়েছে। পিপিআরসি বলছে, নতুন কারখানা বা প্রকল্প না থাকায় নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ বাঁচাতে কর্মী ছাঁটাই করছে। ফলে মানুষের আয় কমছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং দারিদ্র্য বাড়ছে। শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে—অনেক কোম্পানি লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
ডলারের স্থিতিশীলতায় আমদানি ব্যয় কমেছে, যা ওষুধ, কাঁচামাল ও জ্বালানির সরবরাহে স্বস্তি দিয়েছে। মূল্যস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এই পরিবর্তনগুলো মূলত ব্যবস্থাপনাগত; অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার এখনো কার্যকর হয়নি।
বিনিয়োগই প্রবৃদ্ধি ও চাকরির প্রধান চালিকাশক্তি। বিনিয়োগ কমলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও ভোগব্যয়—সবই কমে যায়। এখন সেই প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজার ও শেয়ারবাজারে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলার দুরবস্থা ও ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতির কারণে অনেকেই শ্রমবাজার থেকে সরে যাচ্ছেন।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। গাজীপুরে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের অনেকেই এখন জীবিকার জন্য ফুটপাতে বা বাজারে সবজি বিক্রি করছেন।
প্রবৃদ্ধি কমে গেলে কী ঘটে
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জাওয়াদুল কারিম বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানে দেশের মোট উৎপাদন ও আয়ের হার। প্রবৃদ্ধি বাড়লে জীবনমান উন্নত হয়, আর কমে গেলে সমস্যা তৈরি হয়।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। কোভিড-১৯ ছাড়া গত দুই দশকে এত কম প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
কারিমের মতে, প্রবৃদ্ধিই অর্থনীতির প্রাণ। প্রবৃদ্ধি বাড়লে নতুন কারখানা গড়ে ওঠে, ব্যবসা বাড়ে, চাকরি তৈরি হয়, আয় ও ভোগব্যয় বেড়ে অর্থনীতি ইতিবাচক চক্রে প্রবেশ করে।
কিন্তু প্রবৃদ্ধি কমে গেলে চাকরির সুযোগ সবার আগে সংকুচিত হয়। বিনিয়োগ না থাকায় নতুন শিল্প গড়ে উঠে না। প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ বন্ধ করে বা ছাঁটাই করে। এতে আয় কমে এবং মূল্যস্ফীতির চাপে বাস্তব আয় আরও কমে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিনমজুরেরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন, আর ধনী শ্রেণি তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে বা লাভবান হয়। ফলে আয়-বৈষম্য বেড়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদে পরিবারগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমায়। ভোগ কমলে বিনিয়োগও কমে। তখন অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে—আয় কমে, বৈষম্য বাড়ে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির ধাক্কা শুধু পরিসংখ্যান নয়; এটি চাকরি, আয় ও জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে এই সংকটকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই নীতি নেওয়ার সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।’
দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান
বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক জরিপ দেখিয়েছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ পূর্ণাঙ্গ চাকরিতে যুক্ত নন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করলে একজনকে কর্মজীবী ধরা হয়। কিন্তু অনেকেই সপ্তাহে পূর্ণ ৪০ ঘণ্টা কাজ পাচ্ছেন না। চারজন কর্মজীবীর একজন (৩৮%) আন্ডারএমপ্লয়েড বা ছদ্মবেকার।
নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ আরও কম। কর্মক্ষম বয়সী নারীদের মাত্র ২৬% কাজ করছেন। প্রায় অর্ধেক কর্মজীবী স্বনিয়োজিত, অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। ফলে আয়ের অস্থিরতার কারণে তাঁরা সহজেই দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ছেন।
গত তিন বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। মজুরি বৃদ্ধি প্রায়শই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে বাস্তব আয় কমে যাওয়ার ধারা চলছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কিছুটা অবনতি হলেও, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখনও সীমিত।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর বাংলাদেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হতে পারে। ২০২৫ সালের মে মাসে দেশের দারিদ্র্য হার প্রায় ২৮%। তুলনামূলকভাবে গরিব পরিবারগুলো আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করছে, মধ্যবিত্তরাও খাদ্য খাতে বেশি ব্যয় করছেন।
পিপিআরসির চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখন কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।’
কমছে আয়, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যের চাপ
গত তিন বছরে দেশে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে ছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় হার ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কমলেও জুলাইয়ে আবার বেড়ে তা ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ, ৮ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগ ও অর্থপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
ঢাবির অধ্যাপক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘পাশের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থা স্পষ্ট হয়। শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি নেই। পাকিস্তানে ৪ শতাংশ এবং ভারতে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। নেপালে ২ দশমিক ৭২ শতাংশ। সেই তুলনায় বাংলাদেশে এখনো ৮ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে, যা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টদায়ক।’
খাদ্যপণ্যের দাম পরিস্থিতি আরও কঠিন করেছে। শীতের সময় থেকে চালের দাম বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যতালিকায় ভাতের অংশ বেশি থাকায় তাঁরা বেশি প্রভাব অনুভব করছেন। বর্ষায় সবজির দাম বেড়েছে। সবজি কম খাওয়ায় ডিমের দামও বেড়েছে।
খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে জানালেও মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন নেই। আয় কমে খরচের ক্ষমতা সীমিত হচ্ছে। ফলে ভোগক্ষমতা কমছে, বাজারে চাহিদা কমছে। মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনিয়োগে খরচ কমাচ্ছেন। তাই সামান্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস হলেও সুফল সীমিত।’
মূলধনি পণ্য আমদানি কমেছে, শিল্প স্থবির
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে মূলধনি পণ্যের আমদানি ১০ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। যন্ত্রপাতি সবচেয়ে বেশি—১৯ দশমিক ১ শতাংশ কম। অন্যান্য মূলধনি পণ্য ৫ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। শিল্প ও নির্মাণে প্রয়োজনীয় ক্লিংকারও ৭ শতাংশ কম। ফলে শিল্প আধুনিকায়ন ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
চালের আমদানি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে—২০২৩-২৪ সালে, ২ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪-২৫ সালে ৬৮ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলারে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শিল্প ও উৎপাদনে মূলধনি পণ্যের ঘাটতি উদ্বেগজনক।
বিদেশি বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে, কিন্তু অধিকাংশই পুনর্বিনিয়োগ। নতুন বিনিয়োগ তেমন নেই। আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতি আপাতত স্থিতিশীল, কিন্তু নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি চাপ দিচ্ছে।’
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূলধনি পণ্যের আমদানি নিশ্চিত করা।
বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি আপাতত একধরনের স্থিতিশীলতায় আছে, কিন্তু তা মূলত নিম্নমুখী। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় আঘাত পড়ছে—আয় কমছে, দাম বাড়ছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে।
নীতি নির্ধারকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং শ্রমবাজারে নতুন চাকরি তৈরি করা।
এই তিনটি না হলে সামষ্টিক সূচকে সামান্য উন্নতি হলেও মানুষের জীবনমান উন্নত হবে না। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই পরিবর্তনের ফলে গঠিত হয়েছে দুটি নতুন সংস্থা: রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ
০৮ জুন ২০২৫বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে লিটারে ১৪ টাকা বেড়েছে। পাম তেলের দামও লিটারে বেড়েছে ১২ টাকা। সরকার করছাড় তুলে নেওয়ায় এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি, বাজারে পেঁয়াজ, ডিম এবং সবজির দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। আটার দামও কিছুটা
০৮ জুন ২০২৫