leadT1ad

আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত আন্দোলনকে নিয়ে যায় গণ-অভ্যুত্থানের পথে

মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০২৪। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এই দিনে রংপুরে আবু সাঈদসহ সারা দেশে অন্তত ছয়জন নিহত হন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে আবু সাঈদের দৃঢ়চিত্তে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে যায় গণ-অভ্যুত্থানের দিকে। ফিরে দেখা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’-এর ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক লড়াইয়ের সত্য গল্প।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৫, ১১: ৫৯
দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের গুলির মুখে বুক পেতে দেন আবু সাঈদ। ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে বেলা দুইটা থেকে তিনটা নাগাদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, লাঠিচার্জ করে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পেছনে সরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু আবু সাঈদ তখনো দাঁড়িয়ে।

বেলা ২টা ১৭ মিনিটে পুলিশ গুলি করা শুরু করে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পুলিশ। আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। আবু সাঈদের গায়ে প্রথম গুলি লাগে ২টা ১৭ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলি ছোড়া হয় এর ঠিক ৮ ও ৯ সেকেন্ড পর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। বেলা ২টা ১৮ মিনিট নাগাদ আবু সাঈদকে দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা ৩টা ৫ মিনিটে হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর শরীরে একাধিক শটগানের গুলির আঘাত ছিল। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল।

আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, নতুন মাত্রা পায় আন্দোলন।

সারা দিন যা ঘটেছিল

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করে। এর প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই দিন আবারও দেশব্যাপী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পাশাপাশি পুলিশও মারমুখী অবস্থান নেয়।

১৬ জুলাই বেলা ১১টার দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরা বাড্ডা-রামপুরা সড়ক অবরোধ করেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই অবরোধে যোগ দেন।

একই সময় ময়মনসিংহ, বগুড়া, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুরসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। অনেক জায়গায় ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

দুপুরে রংপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন।

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

নগরীর যাত্রাবাড়ী, সায়েন্স ল্যাব, প্রগতি সরণি, শান্তিনগর, বাড্ডা, মতিঝিল শাপলা চত্বর, তাঁতীবাজার, বেড়িবাঁধ, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে মহাখালীতে শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করলে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কেও এ দিন অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন। এরপর তাঁরা বিক্ষোভ করেন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।

দুপুরে চট্টগ্রামের মুরাদনগরে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। হামলায় চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আকরাম (২৪), ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ (২৪) ও ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ফারুক (৩২) নিহত হন। আহত হন বেশ কয়েকজন।

বিকেলে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করে ঢাকা কলেজ ও সায়েন্স ল্যাব এলাকায়। ফুটপাতের দোকানদার মো. শাহজাহান (২৪) ও সবুজ আলী (২৫) নিহত হন।

বিকেলে আন্দোলনের তীব্র রূপ পেলে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া ও চট্টগ্রামে বিজিবি মোতায়েন করে সরকার। এদিন সন্ধ্যায় দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাঅ হয় স্থগিত।

রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে মঙ্গলবারের কর্মসূচি শেষ করে রাত আটটার দিকে হলে ফিরে যান।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ১৬ জুলাই দেশব্যাপী সহিংসতাকে ‘রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট দমন-পীড়ন’ হিসেবে আখ্যা দেন। আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ১৭ জুলাই (বুধবার) দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

প্রতিক্রিয়া

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ অ্যাকশন নেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে এই আন্দোলনের মোকাবিলা করবে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ১৭ জুলাই সকাল থেকে নিজ নিজ ইউনিট অফিসে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়।

তবে এই দিনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।

এ দিন দেশের সাধারণ মানুষ ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেয় ছাত্রদলও।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছয়জন নিহতের ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাউথ এশিয়া, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন ও সুশাসনের জন্য নাগরিক পৃথক বিবৃতিতে নিন্দা জানায়।

এ ছাড়া দেশের অন্তত ১১৪ বিশিষ্ট নাগরিক এক যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানান।

Ad 300x250

সম্পর্কিত