leadT1ad

‘এখন না গেলে বার্তা যাবে, আমরা ভয় পেয়েছি, যা হবে রাস্তায় দেখা যাবে’

পথে মোস্তফাপুর এলাকায় পুলিশ প্রথমে তাদের বহর থামিয়ে বলে, ‘সভাস্থলে সমস্যা রয়েছে, ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছি না।’ এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ পুলিশকে জবাব দেন, ‘এখন না গেলে বার্তা যাবে, আমরা ভয় পেয়েছি। যা হবে রাস্তায় দেখা যাবে।’

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৫, ২২: ০২
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৫, ২২: ০৪
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা, ১৪৪ ধারা জারি। ছবি: সংগৃহীত

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হামলা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। জেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বুধবার রাত ৮টা থেকে পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর আগে সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল জেলা প্রশাসন। বিজিবি ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরও সহিংসতা থামেনি।

এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর সহিংস হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে জামায়াতে ইসলামী ও গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় গণমাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। বিবিসি বাংলা নিহতের সংখ্যা ৪ জন বলে জানিয়েছে।

একবছর আগে এই দিনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন আবু সাঈদ। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি নিয়ে গোপালগঞ্জে প্রবেশ করেছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এর পরই এ সব ঘটনা ঘটলো।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির পদযাত্রাকে ঘিরে সকাল থেকেই গোপালগঞ্জে বিরাজ করছিল অস্বাভাবিক উত্তেজনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রলীগপন্থিদের একাধিক ফেসবুক পোস্টে প্রকাশ্য হুমকি দেখা যায়—‘নাহিদ ইসলামদের গোপালগঞ্জে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

সকাল ১১টার দিকে বরিশাল থেকে মাদারীপুর হয়ে গোপালগঞ্জের পথে যাত্রা শুরু করে এনসিপির প্রায় ১৫-১৬টি গাড়ির বহর। পথে মোস্তফাপুর এলাকায় পুলিশ প্রথমে তাদের বহর থামিয়ে বলে, ‘সভাস্থলে সমস্যা রয়েছে, ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছি না।’ এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ পুলিশকে জবাব দেন, ‘এখন না গেলে বার্তা যাবে, আমরা ভয় পেয়েছি। যা হবে রাস্তায় দেখা যাবে।’ এরপর বহর গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে।

বেলা বাড়তেই শহরের উত্তেজনা ভয়াবহ রূপ নেয়। সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে গোপালগঞ্জ সদরের উলপুর এলাকায় একটি পুলিশের জিপে অগ্নিসংযোগ করে একদল হামলাকারী। গোপালগঞ্জ থানার ওসি মীর মো. সাজেদুর রহমান দাবি করেন, এ হামলার পেছনে ‘নিষিদ্ধঘোষিত’ ছাত্রলীগের কর্মীরা ছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল এনসিপির কর্মসূচিকে বানচাল করা। দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে কংসুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও রকিবুল হাসানের গাড়িবহরেও হামলা হয়।

তিনি জানান, পূর্বের অগ্নিসংযোগস্থল পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে বহরে ইট-পাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় একজন চালক সামান্য আহত হন।

স্মরণসভা পরিণত হলো রণক্ষেত্রে

বিকেল ২টার দিকে গোপালগঞ্জ পৌরপার্কে শুরু হয় এনসিপির পথসভা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সহসভাপতি নিভা, সারজিস আলমসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। তারা মুজিববাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বক্তব্য দেন।

কিন্তু সভা চলাকালে হামলার খবর আসে—এনসিপির মঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়েছে, চেয়ার-মাইক-প্যান্ডেল সবকিছু ভাঙচুর করা হয়েছে, ককটেল ফাটানো হয়েছে। সাংবাদিকদের সামনেই এসব ঘটে। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়। এর মধ্যেও এনসিপি নেতারা মঞ্চ পুনর্দখল করে সভা শেষ করেন।

পথসভা শেষে মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর আবারও হামলার মুখে পড়ে লঞ্চঘাট এলাকার কাছে। কয়েক শত লোক বহরের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। সাংবাদিকদের গাড়ির গ্লাসও ভাঙে, আহত হন অন্তত একজন এনসিপি নেতা। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রথমে সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। সাজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনী সামনে দাঁড়ালেও বহরের উপর হামলা চলতেই থাকে। নিরাপত্তার অভাবে এনসিপি নেতারা বহর ঘুরিয়ে বিকল্প পথে শহর ছাড়তে চাইলে সেটাও ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে।

তবে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ও অচিরেই পরিণত হয় অবরুদ্ধ অবস্থানে। টানা দুই ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন এনসিপি নেতারা। চারপাশে জমে ওঠে উত্তেজিত জনতা, শুরু হয় ইট-পাটকেল ছোড়া, ভবনে ভাঙচুর। আশপাশের এলাকায় মাইকিং করে বলা হয়, ‘এখানে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে বেরিয়ে আসুন।’ এতে ভিড় করে আশপাশের লোকজন। এ সময় ডিসি অফিসেও হামলা চালানো হয়। মঞ্চে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, প্লাস্টিক চেয়ার পুড়ে কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে পড়ে পৌরপার্ক ও আশপাশ। হামলাকারীদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা যায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় উদ্ধার

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সেনা, র‍্যাব, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করে। তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলে এনসিপি নেতাদের পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে উদ্ধার করে একটি সাঁজোয়া ট্যাঙ্কে তুলে নিরাপদে বের করে আনে। ট্যাঙ্কের পেছনে থাকে র‌্যাব-পুলিশের প্রহরায় বাকি গাড়িগুলো। তবে শহর ছাড়ার সময়ও তারা হামলার শিকার হন—গলি, ছাদ, দোকানের আড়াল থেকে ছোঁড়া হয় ইট-পাটকেল।

শেষ পর্যন্ত বাগেরহাটে এক বিরতির পর এনসিপি নেতারা সেনা ট্যাঙ্ক থেকে নেমে নিজেদের গাড়িতে ওঠেন এবং সেখান থেকে খুলনার দিকে যাত্রা করেন। রাতে তারা খুলনায় পৌঁছে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং এই হামলার জন্য ‘আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ’কে দায়ী করেন।

এদিনের সহিংসতায় অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। নিহতরা হলেন গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের দীপ্ত সাহা (২৫) এবং কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮)। এছাড়া আহত হয়েছেন দুই ডজনেরও বেশি মানুষ, যার মধ্যে পুলিশ, এনসিপি কর্মী এবং সাধারণ পথচারীরাও রয়েছেন।

সরকার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সহিংস কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করা হবে। সেনা ও পুলিশ বাহিনীর ধৈর্যের কারণে প্রাণহানি সীমিত রাখা গেছে।’ রাত আটটা থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পুরো গোপালগঞ্জ জেলায় কারফিউ জারি করা হয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘গোপালগঞ্জে যা হয়েছে, তা এক দানবীয় হামলা। একটি অস্থায়ী সরকারের আমলে এভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কল্পনাতীত।’ এদিকে এনসিপি ও তাদের ছাত্রসংগঠন বৃহস্পতিবার সারাদেশে অবরোধের ডাক দিয়েছে।

এনসিপির ভাষ্য, ‘আবু সাঈদের রক্তকে কেন্দ্র করে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার বদলে গোপালগঞ্জে আমরা দেখলাম আগুন, রক্ত, বন্দুক, মিথ্যা স্লোগান আর প্রতিহিংসা।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত