leadT1ad

ফিরে দেখা ১৯ জুলাই

দ্বিতীয় দিনে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, ১৪৮ শহীদ, কারফিউ জারি

১৯ জুলাই ২০২৪। আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি। হেলিকপ্টার থেকে র‍্যাবের গুলিবর্ষণ। রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ—ঢাকা যেন হয়ে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্র। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি জনতাকেও এ দিন দৃশ্যমানভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে দেখা যায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোয় ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে জন্ম নিয়েছে কত না সত্য গল্প। ফিরে দেখা যাক সেসব দিন।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৩১
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৪: ২১
হেলিকপ্টার থেকে র‍্যাবের গুলিবর্ষণ। ছবি: আশরাফুল আলম

ধানমন্ডির আকাশে শাঁ শাঁ করে উড়ে গুলি ফোটাচ্ছিল সরকারি হেলিকপ্টার। আন্দোলনকারী আর ভীতসন্ত্রস্ত মানুষজন হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া দেখে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছিলেন। খানিক বাদে আবার ছুটে আসছিলেন রাস্তায়।

গত বছরের ১৯ জুলাইয়ের এসব কিছু রিকশাচালক মফিজ উদ্দিনের স্মৃতিতে এখনো দগদগে, ‘ধানমন্ডি থেকে সেদিন দুইজন গুলি খাওয়া ছাত্রকে হাসপাতালে পৌঁছে দিছিলাম। তাদের মুখের দিকে তাকানো যাইতেছিল না… কেমন যে একটা দিন ছিল!’ চার বছর ধরে ধানমন্ডি-মোহম্মদপুর এলাকায় রিকশা চালানো ৩৯ বছর বয়সী মফিজ উদ্দিন এর বেশি আর কিছুই বললেন না। ছোট্ট করে শুধু বললেন, ‘এ দিনের কথা আমি জীবনেও ভুলব না।’

মফিজ উদ্দিনের মতো ঢাকার অনেকেরই রয়েছে ১৯ জুলাই ২০২৪ নিয়ে এমন স্মৃতি।

পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ। ছবি: আশরাফুল আলম
পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ। ছবি: আশরাফুল আলম

আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি। হেলিকপ্টার থেকে র‍্যাবের গুলিবর্ষণ। রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ—গত বছরের এই আগুন ঝরা দিনে অন্তত ১৪৮ জন নিহত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে কারফিউ জারি করেন তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দিনটি ছিল শুক্রবার। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা সারা দেশে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে রাজধানীতে জনসমাগম ও মিছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এর আগের দিনই (১৮ জুলাই) ইন্টারনেট সেবা দেশব্যাপী বন্ধ করে রাখে সরকার।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল পুলিশ। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন বিজিবিকেও বিভিন্ন স্থানে আগের দিনের তুলনায় বেশি সক্রিয় দেখা যায়। রাজধানীতে ৭৫ প্লাটুন বিজিবি মাঠে ছিল এ দিন।

কিন্তু কোনো বাধাই ঠেকাতে পারেনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে নজিরবিহীন সহিংসতা, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও মৃত্যুতে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকা।

কেবল ঢাকা মহানগরীতেই গুলি ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়। ছাত্র, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারী—মৃত্যুতালিকা থেকে বাদ যায়নি কোনো পেশার মানুষ। এ দিন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি জনতাকেও দৃশ্যমানভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের হত্যার প্রতিবাদে ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানার নিয়ে শাহবাগে দাঁড়ান কয়েক শ মানুষ। বিক্ষেোভ চলে মিরপুরেও। মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশনে ভাঙচুর চালানো হয়।

একই দিন নরসিংদীতে জেলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কয়েক শ লোক বাইরে থেকে কারাফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে সেলগুলো খুলে দেন। ধরিয়ে দেন আগুন। এ সময় প্রায় ৯০০ বন্দি বের হয়ে আসেন কারাগার থেকে। ৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১ হাজার রাউন্ডের বেশি গুলি লুট হয়ে যায়।

দিনভর মৃত্যুর মিছিলের পর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রাতে সেনা মোতায়েন করা হয়।

ছবি: আশরাফুল আলম
ছবি: আশরাফুল আলম

১৪৮ জন নিহত

এ দিন সহিংসতার মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (টিজিআই) প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই এক দিনেই নিহত হন ১৪৮ জন। এর মধ্যে অন্তত ৮৮ জনের তালিকা আছে শহীদ ডট ইনফো নামে স্বেচ্ছাসেবীদের তৈরি ওয়েবসাইটে। আবার ‘ব্লাডশেড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে ৫৪ জনকে মাথায় বা গলায় গুলি করা হয়। অধিকাংশেরই বয়স ছিল ৪০ বছরের মধ্যে। সব মিলিয়ে ১৯ জুলাই ঢাকা যেন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

হেলিকপ্টার থেকে গুলি

রাজধানীর রামপুরায় এ দিন দুপুরের আগে হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়। একই ঘটনা ঘটে ধানমন্ডি ও মোহম্মদপুর এলাকায়ও। এতে আন্দোলনকারীরা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বিকেল চারটার দিকে ওই এলাকাগুলোতে আরও দুই দফা র‌্যাবের হেলিকপ্টার দেখা যায়। বিকেল পাঁচটা থেকে পরের ৪০ মিনিটে রামপুরায় তিন দফায় হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়।

বিকেলে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব ও নিউমার্কেট এলাকা, মোহাম্মদপুর সাতমসজিদ রোডে বাসস্ট্যান্ড ও চাঁন মিয়া হাউজিং এলাকায় যে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়, সেটি ছিল র‍্যাবের কালো রঙের একটি হেলিকপ্টার।

সন্ধ্যার দিকে মহাখালীতে, এর আগে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকাতেও দফায় দফায় সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়।

ছবি: আশরাফুল আলম
ছবি: আশরাফুল আলম

বিএনপির সমাবেশে পুলিশের হামলা

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমর্থনে বেলা তিনটায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘জাতীয় ঐক্য সমাবেশ ও মিছিল’ কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। এ কর্মসূচি ঘিরে দুপুরের আগেই প্রেসক্লাব ও আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেয়। জুমার নামাজ শেষে বিএনপির নেতা–কর্মীদের একটি অংশ প্রেসক্লাবের সামনে এলে পুলিশ তাঁদের ধাওয়া দেয় এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এ সময় টিকতে না পেরে বিএনপির নেতা–কর্মীরা সেগুনবাগিচা ও পল্টন মোড়ের দিকে পিছু হটেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়, যা সংঘর্ষে রূপ নেয়।

শামীম ওসমানের সশস্ত্র হামলা

জুমার নামাজের পরপরই নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া থেকে গাড়িবহর নিয়ে বের হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। এরপর শহরের প্রধান সড়ক ‘বঙ্গবন্ধু সড়ক’-এ দফায় দফায় মহড়া দেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে, স্বজন ও অনুসারী নেতাকর্মীরা। দুই কিলোমিটারজুড়ে প্রকাশ্যে চলে গুলি, কুড়াল ও রামদা হাতে আক্রমণ। নেতাকর্মীরা রিভলভার আর পিস্তল হাতে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।

সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক

এই দিন ‘দ্য রেজিসটেন্স’ নামে একটি হ্যাকার গ্রুপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও র‌্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক করে। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ ঝুলছিল। লেখা ছিল, ‘আমাদের সঙ্গে একাত্ম হোন। সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। একসঙ্গে আমরা একটা পরিবর্তন আনব।’

আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করছে পুলিশ। ছবি: আশরাফুল আলম
আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করছে পুলিশ। ছবি: আশরাফুল আলম

রাতে ৯ দফা ও শাটডাউন চালানোর ঘোষণা

এ দিন রাত ৯টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি জানায়। দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়। বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি মানা হলে তাঁরা ক্যাম্পাসে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সংলাপে বসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

৯ দফার মধ্যে ছিল—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবৈধ উপায়ে ব্যবহার করে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রিপরিষদ ও দল থেকে পদত্যাগ। ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহীদ হয়েছেন, সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ। যেসব পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যেসব সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে, তাদের আটক ও হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার। দেশব্যাপী যেসব শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান।

এ দিন কারফিউ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে এসএমএস পাঠিয়ে বলেন, ‘সরকার ছাত্র ও নাগরিকদের প্রতিরোধের মুখে কারফিউ জারি করেছে, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দমনের জন্য। আমাদের আহ্বান থাকবে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করবেন। সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান থাকবে, এ সরকারকে সমর্থন না দিয়ে ছাত্র-নাগরিকদের মানবাধিকারের পক্ষে যাতে অবস্থান করে।’

Ad 300x250

গাজীপুরে শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ

মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে বার্ন ইনস্টিটিউটে প্রধান উপদেষ্টা

পরিবারের দাবি মৃতদেহ সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে কর্তৃপক্ষ, সরকার বলছে ভিন্ন কথা

চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা

ইসলামি শক্তির ঐক্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে

সম্পর্কিত