leadT1ad

পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যা: সরেজমিন

তালা ঝুলছে মিটফোর্ডের সোহাগের দোকানে, কেউ কথা বলতে রাজি নয়

প্রশ্ন উঠছে, কেন প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিতে ঘটনার পরে দুদিন সময় চলে যায়? ভিডিও ভাইরাল না হলে কি পুলিশ এমন কার্যকরী ভূমিকা নিত? বিচার পাওয়ার জন্য কি এখন তবে ভাইরাল হতে হবে?

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ২১: ০৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) সামনে ‘সেই ঘটনাস্থলে’ আজ রোববার (১৩ জুলাই) সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, একটি পাথর ঘিরে কিছু মানুষের জটলা। দর্শনার্থীরা ভিড় করে পাথরটি দেখছেন এবং ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন।

পাথরটি পাহারা দিচ্ছিলেন একজন পুলিশ। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হলেন না। এরপর ঘটনাস্থলের আশপাশের দোকান, ফুটপাতের ভাসমান দোকান, হাসপাতালের কর্মী—কেউই এ বিষয়ে টু শব্দ করতে রাজি হলেন না। তাঁদের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ছিল স্পষ্ট।

পরে ৪ নম্বর রজনী বোস লেনে নিহত সোহাগের ‘সোহানা মেটাল’ দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। দোকানের প্রোপ্রাইটর হারুন-উর-রশিদকেও ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। সোহানা মেটালের আশপাশের দোকানদারেরাও এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার জানান, তারা যদি সেদিন চুপ না থেকে একসঙ্গে প্রতিবাদ করতেন, তাহলে হয়তো সোহাগকে বাঁচানো যেত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক সিএনজি চালক জানান, খুনের ঘটনা অস্বভাবিক হলেও এই এলাকায় চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপের মারামারি প্রায়শই ঘটে।

স্থানীয়রা জানান, নিহত সোহাগ কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন আবাসিক এলাকায় একটি বাড়ির নবম তলায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনে গিয়ে অনেকের কাছেই সোহাগের বাসার খোঁজ করা হলেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংস হত্যার ঘটনাটি ঘটে গত বুধবার (৯ জুলাই)। কিন্তু সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় দুদিন পর (১১ জুলাই)। এরপর সক্রিয় হয় প্রশাসন এবং অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এমন একটি ঘটনায় প্রশাসনের সক্রিয় হতে কেন দুদিন সময় লাগল, তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

নিহত সোহাগের ‘সোহানা মেটাল’ দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। স্ট্রিম ছবি
নিহত সোহাগের ‘সোহানা মেটাল’ দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। স্ট্রিম ছবি

যেভাবে ভাইরাল হয় সোহাগ হত্যার ভিডিও

প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যা ও মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে খুনিদের উল্লাস করার একটি ভিডিও গত শুক্রবার (১১ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

পরে জানা যায়, নৃশংস ওই হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে। যাঁকে হত্যা করা হয়ছে তাঁর নাম লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯)। তিনি সেখানে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসা করতেন বলে জানা গেছে।

মূল ঘটনার প্রায় দুদিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমগুলোর টনক নড়ে। শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ, তদন্ত ও ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গতকাল শনিবার (১২ জুলাই) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের এক পোস্টে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জনপরিসর—সবখানেই বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই অমানবিক হত্যাকাণ্ড। প্রশ্ন উঠছে, প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিতে ঘটনার পর দুদিন লাগল কেন? ভিডিও ভাইরাল না হলে কি পুলিশ কোনো কার্যকর ভূমিকা নিত?

সংবাদমাধ্যমে আসতে এত দেরি কেন

ম্যাকনেইলি ও হ্যামন্ডের ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এখনকার মিডিয়া অনেকটাই ‘দৃশ্যনির্ভর’ হয়ে পড়েছে। পাঠক বা দর্শক এখন কেবল লেখা পড়তে আগ্রহী নয়। তাই ভিডিও, ছবি, সিসিটিভি ফুটেজ না থাকলে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও খবর হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটছে বলে মনে করেন অনেকে।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশই বিভিন্ন ঘটনায় নিজেরা তদন্ত করে না। এই ধরনের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমগুলো অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলনের ওপর নির্ভর করে। পুলিশ যেহেতু কিছু বলেনি, সেহেতু ‘ঘটনা নিশ্চিত নয়’, তাই আর রিপোর্ট করা হয় না।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংবাদমাধ্যমে বর্তমানে কোন খবর প্রচার করা হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে ভিউ সংখ্যা, রাজনৈতিক ফায়দা ও ব্যবসায়িক লাভের সম্ভাবনার ওপর।

এই পাথর দিয়েই সোহাগকে থেতলে হত্যা করা হয়েছে। স্ট্রিম ছবি
এই পাথর দিয়েই সোহাগকে থেতলে হত্যা করা হয়েছে। স্ট্রিম ছবি

প্রশাসনের গাফিলতি

রাজধানীর ব্যস্ত এলাকার একটি সরকারি হাসপাতালের সামনে জনসমক্ষে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম দুদিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক দাবি করেন, বর্তমানে অনেক অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ নিজে থেকে তদন্ত শুরু করে না, বরং ভিডিও ভাইরাল হলে বা সিসিটিভি ফুটেজ হাতে এলে তবেই তারা কাজ শুরু করে।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধের সঙ্গে স্থানীয় চাঁদাবাজ, রাজনৈতিক ক্যাডার বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সম্পর্ক থাকলে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্ত স্থগিত রাখে। ঊর্ধ্বতনমহল থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই নিষ্ক্রিয়তা ঘটনাটিকে ‘ঢাকতে’ চেষ্টা করা অব্দি গড়ায়।

বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা গতকাল শনিবার ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির এক আলোচনা সভায় অভিযোগ করেন, ‘সোহাগ হত্যার সময় মাত্র ১০০ মিটার দূরে আনসার ক্যাম্প ছিল, পুলিশও ছিল—তাহলে তারা কী করল? ভিডিও না আসা পর্যন্ত সরকার কী পদক্ষেপ নিল?’

লেখক ও গবেষক জিয়া হাসান তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ বাহিনীর ন্যূনতম সংস্কার হয়নি। শেখ হাসিনার ফেলে যাওয়া পুলিশই ফিরে এসেছে। ন্যূনতম আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়নি। হত্যার দুদিন পর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রশাসন কিছুই করেনি। একবার ভাবুন, এই ধরনের কত অপরাধ চোখের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ভাইরাল না হলে বিচার হচ্ছে না।

কেন দুদিন সময় লাগল

মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, অনেকেই পুরো ঘটনাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কেউবা আবার পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। সামাজিক মনোবিজ্ঞানের ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট’ থেকে জানা যায়, এই ধরনের ঘটনায় যেখানে অনেক মানুষ উপস্থিত থাকে, সেখানে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা কমে যায়। প্রত্যেকে ভাবে, ‘অন্য কেউ নিশ্চয়ই কিছু করবে।’ তাই অনেকেই চুপচাপ দেখে যায় অথবা নিরবে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

কিন্তু মিটফোর্ডের ঘটনার ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরও গভীরে। ঘটনা ঘটার সময় কেউ বাধা দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, এরপরের দুদিনেও ঘটনাটি নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের কোনো সামাজিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এই ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ কিছু বলেনি।

অপরাধবিজ্ঞানী গ্যারি লাফ্রি মনে করেন, প্রতিশোধের ভয় (ফিয়ার অব রিটালিয়েশন) থেকেই মানুষ সাধারণত এ ধরনের আচরণ করে থাকে। অনেক সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় কিছু বলতে কিংবা পুলিশকে জানাতে ভয় পান।

সমাজবিজ্ঞানী দিয়াগো গামবেত্তার মতে, এই ধরনের আচরণের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো ‘সামাজিক নীরবতা’ (সোশ্যাল কোড অব সাইলেন্স)। তিনি মনে করেন, কোনো কোনো সমাজে অলিখিত নিয়ম চালু থাকে যে, সাধারণ মানুষ অপরাধ বা আইনি বিষয়ে কোনো কথা বলবে না। গ্যাং সংস্কৃতি বা অপরাধপ্রবণ পরিবেশে মানুষ এই ভেবে ভয় পায় যে এসব ব্যাপারে কথা বললেই বিপদে পড়তে হবে। এই নীরবতা দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলার অবনতিকেই নির্দেশ করে।

মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্ডুরার মতে, এই ধরনের ঘটনা অনেককে মানসিকভাবে বিভ্রান্ত করে ফেলে। আর তাই নৈতিকতা ও ন্যায্যতার অনুভূতিকে দূরে ঠেলে চুপ থাকাটাকেই তারা নিরাপদ ও শ্রেয় মনে করেন।

এ কারণে এমন নৃশংস ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতেও দুদিন সময় নেয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত