leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস

প্রতিবন্ধীদের বরাদ্দে সূচনা ফাউন্ডেশনের থাবা, ধুঁকছে অন্যরা

ইমরান নাফিস
ইমরান নাফিস
ঢাকা

স্ট্রিম গ্রাফিক

আজ ৩ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। বিশ্বে যখন দিবসটি পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী সেবাখাতের করুণ চিত্র সামনে আসছে। অভিযোগ উঠেছে, গত এক দশকে অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ব্যাংকগুলোর সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি) তহবিলের সিংহভাগ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’। অন্যদিকে তহবিলের অভাবে ধুঁকছে প্রতিবন্ধীবান্ধব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

সূচনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এজাহার বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রভাব বিস্তার ও ব্যাংকারদের একটি সিন্ডিকেট ব্যবহার করে সিএসআর তহবিলের অর্থ একচেটিয়াভাবে সরিয়ে নিয়েছে সূচনা ফাউন্ডেশন। হাজার কোটি টাকা লোপাট করলেও মাঠ পর্যায়ে তাদের কোনো কার্যক্রম খুঁজে পায়নি দুদক। এমনকি কার্যালয় পর্যন্ত নেই।

দুদক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের যোগসাজশে ব্যাংকগুলোকে জিম্মি করে এই অর্থ আদায় করা হতো। এ ঘটনায় গত ২০ মার্চ দুদকের উপপরিচালক তাহাসিন মুনাবীল হক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

২০১৭ সালের মে মাসে আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে ১৩৬ কোটি টাকার অনুদান নেওয়া হলেও মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—ওই দিন ১৭টি ব্যাংক থেকে সূচনা ফাউন্ডেশন নিয়েছিল ২১ কোটি টাকা। ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে ২০টি ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট ৩৩ কোটি ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বলে গত মার্চের মামলায় উল্লেখ করা হয়।

​তবে দুর্নীতির এই চিত্র ছিল কেবল হিমশৈলের চূড়া। এজহারের ওই ৩৩ কোটি টাকার বাইরেও দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরও ভয়াবহ তথ্য। গত সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ দুদক জানায়, প্রতিবন্ধীদের সহায়তার নামে 'সূচনা ফাউন্ডেশন' খুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে প্রায় ৪৪৮ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

একই সঙ্গে ৯৩০ কোটি টাকার বেশি সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে মামলা করেছে সংস্থাটি।

দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গত ২৯ জানুয়ারি সূচনা ফাউন্ডেশনের নিবন্ধিত ঠিকানা ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাসায় অভিযান চালিয়ে বাস্তবে কোনো কার্যালয় পায়নি। ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে মনে করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

২০১৪ সালে পুতুল দুই বছরের জন্য সূচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান করা হয়। প্রতিবন্ধীদের আর্থিক সহযোগিতার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি করা হয়েছিল। পরে ২০১৭ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সায়মা ওয়াজেদকে বাংলাদেশ অটিজম ও স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা নিরসনে গঠিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির কার্যাবলি সম্পাদনে সহায়ক ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য গঠিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পুতুল সূচনা ফাউন্ডেশনের হর্তাকর্তা হয়ে যান।

সূত্রের দাবি, সূচনা ফাউন্ডেশনকে সিএসআর ফান্ড থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংক দুটি দিয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। বাকি ব্যাংকগুলো পাঁচ লাখ টাকা থেকে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত দিয়েছে। এই ফাউন্ডেশনে টাকা দেওয়া ব্যাংকের মধ্যে আরও রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং এনআরবিসি ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সূচনা ফাউন্ডেশনের আগ্রাসনের সরাসরি প্রভাব পড়েছে ছোট ও মাঝারি এনজিওগুলোর ওপর। সাভারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) দীর্ঘ দুই যুগের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে কাজ করলেও ফান্ডের অভাবে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।

সিডিডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যবস্থা বাস্তবে খুব কঠিন। নিয়ম অনুযায়ী মূল্যায়ন বা সিলেকশনের মাধ্যমে ফান্ড পাওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে রাজনৈতিকভাবে যাদের সঙ্গে এলাইনমেন্ট থাকে, তারাই অগ্রাধিকার পায়। সূচনা ফাউন্ডেশন অনেক ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছে এই অভিযোগ সত্য হলেও, আমাদের অভিজ্ঞতা হলো— সিএসআর তহবিল থেকে টাকা পাওয়া খুবই কঠিন। প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ আর ন্যায্য হলে পুরো সেক্টরটাই উপকৃত হতো।’

তৃণমূলের প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করা উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউডিডিএফ) নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছি, কিন্তু কখনোই কোনো ব্যাংকের সিএসআর ফান্ড পাইনি। চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এক পর্যায়ে দেখি অফিস শেষে বা ছুটির দিনে ব্যাংক কর্মকর্তারা অপ্রাসঙ্গিকভাবে ফোন দেন, বিশেষ করে আমার নারী সহকর্মীদের। নারী নেতৃত্বের সংগঠন হিসেবে এই অনৈতিক পরিবেশ মেনে না নিয়ে আমরা সিএসআরের জন্য আর চেষ্টা করিনি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক জরুরি প্রয়োজন যেমন: আর্টিফিশিয়াল লিম্ব, হুইলচেয়ার, ম্যাগনিফায়ার দাতার তহবিলে কাভার করে না। আমাদের এক ইন্টার্নের দুটি পায়ে ২০ ইঞ্চির গ্যাপ, আরেক ছাত্রীর এক পা ১৫ ইঞ্চি ছোট। ৩৫ হাজার টাকার একটি আর্টিফিশিয়াল লিম্ব কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। সিএসআর থাকলে আমরা তাদের এই মৌলিক সাপোর্ট দিতে পারতাম।’

সিএসআর বিতরণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকাকে মূল সমস্যা হিসেবে দেখছেন সিডিডির নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসনাৎ মোহাম্মদ নোমান খান। তিনি বলেন, ‘সিএসআর তহবিলের কোনো জবাবদিহিতা নেই। কে তহবিল পাচ্ছে, কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে– এসব তদারকি করার মতো কার্যকর পদ্ধতি নেই।’

পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় গত ২৭ নভেম্বর পুতুলকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পুতুলের বিরুদ্ধে আরও একাধিক অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভুয়া সনদের মামলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে আবেদনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কাজ করার যে অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছিলেন, তা ভুয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে পুতুলের বক্তব্য জানতে তাঁর ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলেও, সাড়া পাওয়া যায়নি। বিএবির তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকে কল দিলে রিসিভ হয়নি।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত