বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তি ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরাসরি জড়িত ছিল। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সার্বিক বিষয় অনুসন্ধানে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আজ রোববার এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান ও অন্যান্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে প্রতিবেদনটি জমা দেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন– মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক, যুগ্মসচিব (অব.) মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, ডিআইজি (অব.) ড. এম. আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ খান চন্দন।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে ছিল। আপনারা সত্য উদ্ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন জাতি তা স্মরণে রাখবে। জাতির পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাসের এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে জাতির অনেক প্রশ্ন ছিল। এই কাজের মধ্য দিয়ে সেসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে।’
কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান এ সময় বলেন, ‘তদন্তকাজ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ত্রুটিমুক্ত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রাখা হয়েছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন ১৬ বছর আগের এই ঘটনার বহু আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। আমরা দুটো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি। সাক্ষীদের ডাকলাম, কারো কারো ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বক্তব্য শুনেছি আমরা, যতক্ষণ তিনি বলতে চেয়েছেন। যারা তদন্তে জড়িত ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের তদন্তের রিপোর্ট কালেক্ট করেছি, অন্যান্য এলিমেন্ট কালেক্ট করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই তদন্তের মাধ্যমে বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনমনে থাকা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে, উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে কার কী ভূমিকা ছিল। কেন সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকল; অ্যাকশন নিল না।’
কমিশন প্রধান বলেন, ‘তদন্তে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে।’
এ সময় কমিশনের পাওয়া তথ্য সম্পর্কে জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, ‘এই ঘটনা কিছু বাহ্যিক ও প্রকৃত কারণ বের করেছে কমিশন। এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত এবং এর পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিল তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস।’
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের রক্ষা করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা ২০-২৫ জনের একটি মিছিল নিয়ে পিলখানায় ঢুকেছে এবং বের হবার সময় সেই মিছিলে দুই শতাধিক মানুষ ছিল।’
তদন্ত কমিশনের এ সদস্য বলেন, “পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল।”
তিনি এই ঘটনার দায় নিরূপণের ক্ষেত্রে বলেন, ‘দায় তৎকালীন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধানেরও। এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও রয়েছে চরম ব্যর্থতা। ওই ঘটনার সময় কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল অপেশাদার।
ওই হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) যেসব বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেছে, তাদের সঠিক নাম পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করেছে, যেন ভবিষ্যতে বাহিনীগুলোতে এই ধরনের ঘটনা এড়ানো যায় এবং এই ঘটনার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পায়।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ ও স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি।