গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক’ বা ‘ইলেকশন অবজারভারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা নির্বাচনের ‘চোখ ও কান’ হিসেবে কাজ করেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন কিনা, কোনো কারচুপি হচ্ছে কিনা কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা—এসব বিষয় তদারকি করে প্রতিবেদন দেওয়াই তাদের কাজ।
বাংলাদেশে গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, তাদের নিরপেক্ষতা ও কার্যক্রম নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ‘একতরফা নির্বাচন’, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচনে’ দলীয় পরিচয় বিবেচনায় পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভিসা জটিলতার বিষয়গুলো বারবার সামনে এসেছে।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগে—বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক আসলে কারা, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া কী, তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী এবং কেন এই বিষয় প্রতিনিয়ত বিতর্কের জন্ম দেয়।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক আসলে কারা?
সহজ কথায়, নির্বাচন পর্যবেক্ষক হলেন এমন ব্যক্তি বা সংস্থার প্রতিনিধি, যারা ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন কিন্তু এতে সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ করেন না।
বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের পর্যবেক্ষক দেখা যায়:
১. দেশি পর্যবেক্ষক (লোকাল অবজারভার): স্থানীয় এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যারা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন নিয়ে কাজ করে।
২. বিদেশি পর্যবেক্ষক (ইন্টারনেশনাল অবজারভার): বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা (যেমন—ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, এনডিআই) বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক নীতিমালা-২০১৭ (সংশোধিত ২০২৩) অনুযায়ী এই পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়।
পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন ও নিয়োগ প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে চাইলেই যে কেউ হঠাৎ করে ভোটের দিন পর্যবেক্ষক হতে পারেন না। এর জন্য দীর্ঘ ও আমলাতান্ত্রিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ ও সামাজিক যোগাযোগ অধিশাখা মূলত এই বিষয়টি তদারকি করে।
নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করতে হলে প্রথমে ইসির কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদনকারী সংস্থাকে অবশ্যই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বা এনজিও বিষয়ক ব্যুরো অথবা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হতে হয়। সংস্থার গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হয় যে, তারা গণতন্ত্র, সুশাসন বা মানবাধিকার ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে কাজ করে।
আবেদন জমা পড়ার পর নির্বাচন কমিশন প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে। সংস্থাটির রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও তহবিলের উৎস যাচাই করা হয়। এই পর্যায়ে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তা নেয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যদি কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড বা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদের আবেদন বাতিল করা হয়।
এরপর ইসি ওই সংস্থাকে পাঁচ বছরের জন্য নিবন্ধন দেয়। তবে নিবন্ধন পেলেই কাজ শেষ নয়। নির্বাচনের আগে ওই সংস্থা কতজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে চায়, তার তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ইসির অনুমোদিত ব্যক্তি তখন নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষকদের নামে পরিচয়পত্র বা কার্ড ইস্যু করেন। এই কার্ড ছাড়া কেউ ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন না।
পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা
নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী, দেশি পর্যবেক্ষককে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে ও বয়স কমপক্ষে ২৫ বছর হতে হবে (কিছু ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য)। পর্যবেক্ষককে ন্যূনতম এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পর্যবেক্ষককে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা থাকা যাবে না। নির্বাচন কমিশন বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে হবে ও নির্বাচনী আইন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হন বা কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট হন, তবে তিনি পর্যবেক্ষক হতে পারবেন না। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবী, লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি ও আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা পর্যবেক্ষক হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পর্যবেক্ষক যে এলাকায় দায়িত্ব পালন করবেন, সেখানে তার কোনো আত্মীয় (যেমন—বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী/স্ত্রী) প্রার্থী থাকলে তিনি ওই নির্দিষ্ট এলাকার পর্যবেক্ষক হতে পারবেন না।
কী করতে পারেন আর কী পারেন না
পর্যবেক্ষকরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া দেখতে পারেন ও ভোট গণনা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। তবে পর্যবেক্ষকরা কোনো ভোটারকে কোনো পরামর্শ দিতে পারেন না। তারা নির্বাচনী কর্মকর্তা বা পোলিং এজেন্টদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
ভোটকেন্দ্রে কোনো অনিয়ম দেখলেও তারা সরাসরি বাধা দিতে পারেন না; তারা কেবল প্রিজাইডিং অফিসারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন এবং নিজেদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করতে পারেন। এছাড়া ভোটকক্ষের ভেতরে গোপন বুথের ছবি তোলা বা ভিডিও করা সবার মতো পর্যবেক্ষকদের জন্যও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়ে এত বিতর্ক?
তাত্ত্বিকভাবে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ মনে হলেও, বাস্তবে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে গভীর বিতর্ক রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-সহ বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছে।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নামসর্বস্ব কিছু সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব সংস্থার অধিকাংশের সঙ্গেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ থাকে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও দেখা গেছে, ইসি যেসব সংস্থাকে নিবন্ধন দিয়েছে, তাদের অনেকেরই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। সমালোচকরা এদের ‘কিংস পার্টি’র মতো ‘কিংস এনজিও’ বা ‘ডামি পর্যবেক্ষক’ হিসেবে অভিহিত করেন। এদের মূল কাজ হয় নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র ঘুরে ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে’ মর্মে সার্টিফিকেট দেওয়া, যাতে আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ব্যারোমিটার হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে অনাগ্রহী। যেমন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জানিয়েছিল যে, বাংলাদেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, তাই তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। এর পরিবর্তে তারা ছোট আকারের বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছিল। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভিসা প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা ও কঠোর শর্ত আরোপের অভিযোগও রয়েছে। এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (আনফরেল)-এর মতো সংস্থাগুলো অতীতে ভিসা জটিলতার কারণে শেষ মুহূর্তে তাদের মিশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ ও ‘সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন’ নামক দুটি সংগঠনের কার্যক্রম ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই সংগঠনগুলো বিদেশি কিছু ব্যক্তিকে বাংলাদেশে এনে ‘আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই ‘পর্যবেক্ষকরা’ আসলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধি নন। কেউ হয়তো কোনো দেশের স্থানীয় কাউন্সিলর বা সাংবাদিক। সমালোচকদের মতে, সরকার সমর্থিত এই গোষ্ঠীগুলো মূলত নির্বাচনের বৈধতা দেওয়ার জন্য একধরনের ‘সাজানো নাটক’ মঞ্চস্থ করে।
অনেক সময় দেখা যায়, দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো নির্বাচনের দিনই তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ ঘোষণা করে দেয়। অথচ বিভিন্ন সংস্থা বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে হয়তো উঠে আসে কেন্দ্র দখল বা জাল ভোটের চিত্র। পর্যবেক্ষকদের এই প্রতিবেদনগুলো কতটা মাঠপর্যায়ের বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি, আর কতটা দাতা বা সরকারের তুষ্টির জন্য তৈরি—তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকে। অনেক এনজিও তাদের ভবিষ্যৎ ফান্ডিং বা সরকারি হয়রানির ভয়ে সত্য রিপোর্ট দিতে সাহস পায় না।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা হলেন গণতন্ত্রের প্রহরী। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাদের উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু গত ১৫ বছর বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা দলীয়করণ ও আস্থার সংকটে ভুগছে। একদিকে নির্বাচন কমিশন দাবি করে তারা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের দাবি—পুরো প্রক্রিয়াই লোক দেখানো।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই পর্যবেক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে। ভুঁইফোড় সংস্থাগুলোকে বাদ দিয়ে অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ সংস্থাগুলোকে সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য ভিসা ও কাজের পরিবেশ সহজ করা জরুরি।
পর্যবেক্ষকদের কেবল ‘পুতুল’ হিসেবে না রেখে, তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো ক্ষমতা বা মেকানিজম তৈরি করা প্রয়োজন। অন্যথায়, হাজার হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগ করলেও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে এবং পর্যবেক্ষকদের তাদের প্রকৃত মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে।
তথ্যসূত্র: নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন বিষয়ক আইন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস, সুশাসনের জন্য নাগরিক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, বিবিসি বাংলা ও ডয়চে ভেলে।