leadT1ad

কচ্ছপ ভোট দেয় না বটে কিন্তু কী দেয়?

সম্প্রতি কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর বলেছেন, ‘কচ্ছপ থাকলেও কি, আর না থাকলেও কি। আমার তো মানুষ বাঁচাইতে হবে। কচ্ছপ কি আমাকে ভোট দিচ্ছে?’। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল সেই বক্তব্য নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ‘উন্নয়ন’-এর পলিটিক্সে কচ্ছপের বাঁচা-মরার টানাপোড়েন নিয়ে এই লেখা।

রাতুল আল আহমেদ
রাতুল আল আহমেদ

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

এই যে ‘কচ্ছপ টচ্ছপ আবার ভোট দেয় নাকি?’ — এই ডায়লগটা শুইনা আপনি যদি হাসেন, তাইলে কংগ্রাচুলেশন্স! আপনি সেই দেশের নাগরিক, যাদের নৈতিক দেউলিয়াত্ব এখন সরকারি গেজেটে ছাপা বাকি।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর একটি বক্তব্য। দেখলাম উনি বলতেসেন, ‘কচ্ছপ থাকলেও কি, আর না থাকলেও কি। আমার তো মানুষ বাঁচাইতে হবে। কচ্ছপ কি আমাকে ভোট দিচ্ছে?’ আর চারপাশে হাসির রোল পড়ে গেল।

এই হাসিটাই আসলে আমাদের রাষ্ট্রের ডায়াগনোসিস রিপোর্ট। এমন একটা দেশ যেখানে যুক্তি এখন লজ্জিত, জ্ঞান এখন বিদেশি ষড়যন্ত্র, আর ‘বাঁচার অধিকার’ এখন জাস্ট ভোটার আইডির সঙ্গে ঝোলানো। জিজেকের ভাষায়, এই হাসিটা আইডিওলজিকাল লাফটার। আমরা জানি পৃথিবী শেষের পথে, জানি প্রবাল মরতেছে, জানি সেন্ট মার্টিনের কচ্ছপ মরে টরে অলমোস্ট শেষ, কিন্তু আমরা হাসি, যাতে সেই ভয়টা টের না পাই। হাসি আমাদের এনেস্থেশিয়া, মাথায় অপারেশনের আগে ইনজেকশন। আমরা জানি, কিন্তু এমনভাবে বাঁচি যেন জানি না।

কিন্তু এর বাইরেও যেটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সেইটা হলো, চৌধুরী সাহেব মনে করেন, মানুষ বাঁচানো আর প্রকৃতি বাঁচানো দুইটা আলাদা প্রজেক্ট। এটা সেই পুরোনো আধুনিকতার মিথ, যেইখানে মানুষ একদিকে, প্রকৃতি অন্যদিকে। কিন্তু ব্রুনো লাতুর বহু আগেই বলছিলেন, আমরা মডার্ন কখনো হইতেই পাইনাই। এর কারণ হচ্ছে আমরা কোনোদিনই মানুষ আর প্রকৃতিকে আলাদা করে থাকতে পারি নাই। মানুষের প্রতিটা কাজেই প্রকৃতি জড়িত, প্রকৃতির প্রতিটা বদলেই মানুষের জীবন বদলে যায়।

এই হাসিটাই আসলে আমাদের রাষ্ট্রের ডায়াগনোসিস রিপোর্ট। এমন একটা দেশ যেখানে যুক্তি এখন লজ্জিত, জ্ঞান এখন বিদেশি ষড়যন্ত্র, আর ‘বাঁচার অধিকার’ এখন জাস্ট ভোটার আইডির সঙ্গে ঝোলানো। জিজেকের ভাষায়, এই হাসিটা আইডিওলজিকাল লাফটার। আমরা জানি পৃথিবী শেষের পথে, জানি প্রবাল মরতেছে, জানি সেন্ট মার্টিনের কচ্ছপ মরে টরে অলমোস্ট শেষ, কিন্তু আমরা হাসি, যাতে সেই ভয়টা টের না পাই। হাসি আমাদের এনেস্থেশিয়া, মাথায় অপারেশনের আগে ইনজেকশন। আমরা জানি, কিন্তু এমনভাবে বাঁচি যেন জানি না।

সেন্ট মার্টিনের কচ্ছপ যখন মারা যায়, তখন তার সঙ্গে মরে স্থানীয় মৎস্যজীবীর ভবিষ্যৎও। কচ্ছপ শুধু একটা প্রাণী না, সে একটা ইকোসিস্টেমের ফাংশন, একটা নেটওয়ার্কের অংশ। যে রাজনীতি এটা বোঝে না, সে রাজনীতি আসলে উন্নয়নের মাপে নিজের কবর খোঁড়ে।

কিন্তু আমাদের রাজনীতি এখনো ভাবে, প্রকৃতি এক্সট্রা ক্যারেক্টার। যেন সিনেমায় তার একটা পাসিং শট থাকবে, কিন্তু স্ক্রিপ্টে ডায়লগ নাই। আর ঠিক এই চিন্তাই উন্নয়নকে আত্মঘাতী করে তুলেছে। জিজেক লেট ক্যাপিটালিজমের এসব কাজকারবার দেখে আমাদের বলসেন, লেট ক্যাপিটালিজম আমাদের নিজেদেরকে ধ্বংসের উদযাপন শেখায়। আর তার কারণ সেটাই এখন একমাত্র সোর্স অব এন্টারটেইনমেন্ট। আমরা যখন সেন্ট মার্টিনে রিসোর্ট বানাই, তখন আমরা গর্ব করি যে ‘দেশ আগাইতেছে’। কিন্তু সেই রিসোর্টের বর্জ্যে যখন কচ্ছপের ডিম পচে যায়, তখন আমরা বলি এসব ‘প্রাকৃতিক ব্যাপার’। এখন কচ্ছপ মরবে, প্রবাল নষ্ট হবে, তারপর আমরা বলবো, ‘মেরিন রিসার্চ সেন্টার’ লাগবে, সেখানে প্রজেক্ট, ফান্ড, ওয়ার্কশপ, সব চলবে। বিপদ নিজেই হয়ে যায় নতুন সুযোগ। এইভাবে উন্নয়ন এক চক্রাকার দুষ্টচক্র তৈরি করে যেখানে সে নিজের ঘায়ের রস নিজেই খেয়ে বাঁচে।

এখন চৌধুরী সাহেব যে যুক্তিটা দেখালেন সেইটা কিন্তু গ্লোবালিও দেখতে পাবেন। ট্রাম্প তো বারবার বলে বেড়ান যে ক্লাইমেট চেঞ্জ পুরো ব্যাপারটাই স্রেফ ভাঁওতাবাজি। তাঁর যুক্তি সোজাসাপটা — এটা বিজ্ঞানীদের ষড়যন্ত্র, পশ্চিমা এলিটদের ভয় দেখানোর খেলা। অন্যদিকে চীন, ভারত বা ব্রাজিল গ্লোবাল সাউথের এসব নেক্সট জায়ান্টগুলো বলে, ‘ইউরোপ কয়লা পোড়ায়ে ধনী হইছে, এখন আমাদের পালা’। এই যুক্তিগুলো বেশ পোস্টকলোনিয়াল, যেন বা একধরনের ঔপনিবেশিক প্রতিশোধের ইকোনমিক সংস্করণ। তারা বলে, ‘তোমরা জলবায়ুর অজুহাতে আমাদের উন্নয়ন ঠেকাইতে চাও, আমরা সব বুঝি!’

এই দ্বন্দ্বে আসলে কেউই নির্দোষ না। পশ্চিমের গ্লোবাল গ্রিন পলিসিও আসলে একটা নতুন নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। খিয়াল কৈরা দেখবেন, তারা কয়লা পোড়ানো বন্ধ করে ইলেকট্রিক গাড়ি বানায়, কিন্তু সেই গাড়ির ব্যাটারির জন্য আফ্রিকার খনিতে শিশুরা কাজ করে। তারা বারবার জিরো কার্বন ইমিশনের কথা বলে ঠিকই, কিন্তু সেই জিরো আসলে অন্য কারো রক্ত-মাংস।

এটাই জিজেকীয় ইকোলজিকাল হিপোক্রিসি, পৃথিবী বাঁচানোর নামে পুঁজির নতুন বাজার তৈরি করা। একদিকে আমাজন জ্বলছে, অন্যদিকে টেসলা উঠতেছে শেয়ার মার্কেটে। একদিকে সমুদ্রের প্রবাল মরে সাদা হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সিলিকন ভ্যালিতে নতুন এআই মডেলের মুখে সাস্টেইনেবল ম্যাটার্সের কথা বলে ভার্চুয়াল মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। এই দ্বিমুখী নৈতিকতা এখন গ্লোবাল কৌতুক — সবাই পৃথিবী বাঁচাতে চায়, কিন্তু কেউ ঠিকঠাক দায়িত্ব নিতে চায় না।

আমরা মোটাদাগে উন্নয়ন মানে বুঝি রাস্তা, বিল্ডিং, ব্রিজ, হোটেল, রিসোর্ট এইসব। কিন্তু উন্নয়ন মানে এখন একধরনের মরাল হ্যালুসিনেশন। যতক্ষণ কিছু একটা উপরে উঠতেছে, আমরা খুশি। কিন্তু কী হারাইতেসে, সেইটা দেখার সময় নাই।

এখন পুরো দুনিয়া গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের আওতায়, যেখানে ‘পরিবেশ রক্ষা’ নিজেই এক মার্কেটিং ব্র্যান্ড। আপনি ইলেকট্রিক গাড়ি কিনে ‘ভালো মানুষ’ হবেন, কিন্তু সেই ব্যাটারির খনিজ উত্তোলনে অন্য দেশের পাহাড় খসে পড়বে— এই দোষটা পড়বে গিয়ে ‘অন্য কারো’ ঘাড়ে।

এটাই জিজেকীয় ইকোলজিকাল হিপোক্রিসি, পৃথিবী বাঁচানোর নামে পুঁজির নতুন বাজার তৈরি করা। একদিকে আমাজন জ্বলছে, অন্যদিকে টেসলা উঠতেছে শেয়ার মার্কেটে। একদিকে সমুদ্রের প্রবাল মরে সাদা হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সিলিকন ভ্যালিতে নতুন এআই মডেলের মুখে সাস্টেইনেবল ম্যাটার্সের কথা বলে ভার্চুয়াল মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। এই দ্বিমুখী নৈতিকতা এখন গ্লোবাল কৌতুক — সবাই পৃথিবী বাঁচাতে চায়, কিন্তু কেউ ঠিকঠাক দায়িত্ব নিতে চায় না।

বাংলাদেশে এই ধারণা আরও অ্যাবসার্ড। প্রকৃতি এখানে উন্নয়নের শত্রু, আর উন্নয়ন নিজেই এক ধর্ম। যে প্রকৃতির কথা বলে, সে ‘দেশবিরোধী’, আর যে বন কাটে, শ্যাওলা উজাড় করে, সে ‘দেশপ্রেমিক’। এই নৈতিক উল্টোপাল্টা অবস্থায় কচ্ছপ মারা মানে উন্নয়ন দৌড়ে জেতা।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে এই কথাগুলো নিয়ে কেউ ক্ষুব্ধ না। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুইটা মিম বানায়, তারপর চুপ। আমরা একটা জাতি হয়ে গেছি যারা নিজেদের ধ্বংস নিয়ে মিম বানায়। আমরা উপকূল হারাচ্ছি, কিন্তু বলছি ট্যুরিজম বাড়তেছে। আমরা শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু বলছি এয়ারপোর্ট হচ্ছে! এই আনন্দই এখন উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন।

এখন হ্যাঁ, প্রকৃতি ভোট দেয় না। মানছি সেটা। কিন্তু সে ঠিকই হিসেব কষে, খুব নির্ভুলভাবে। তার ব্যালট পেপারে আছে নোনা মাটি, মরা নদী, হারানো ফসল। তার ইভিএমে সমুদ্রের স্তর বাড়ে, ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় হয়, বর্ষার দিনতারিখ বদলে যায়। এই ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে কোনো নির্বাচন কমিশন লাগবে না। সেখানে কোনো পুনর্গণনা নাই। আছে শুধু শূন্যতা, নীরবতা, আর মানুষবিহীন দ্বীপ।

ভোট শেষে কচ্ছপ টচ্ছপের দুনিয়া এই প্রকৃতি বলবে: ‘তোমরা ঠিকই বলেছিলে, আমি ভোট দিই না। তাই এবার তোমরাও থাকো ভোটের বাইরে।’

কচ্ছপ ভোট দেয় না দেখে যদি আপনার হাসি পায়, তবে জানবেন, সেই হাসির ভেতরেই আছে আপনার গোরস্থানের অ্যাড্রেস। কারণ প্রকৃতি শত্রু না, আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী না। সে-ই আসলে আমাদের একমাত্র রাজনৈতিক মিত্র, যে ভোট দেয় না ঠিকই, কিন্তু তাকে ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই নেই। এই সম্পর্কটাকে যারা বোঝে না, তাদের হাসির শব্দই হবে পৃথিবীর শেষ সাউন্ডট্র্যাক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত