‘অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার’শিরোনামে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে নতুন সামরিক অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযান শুরুর কথা বলেন। জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স সাউদার্ন স্পিয়ার এবং সাউথকম এর নেতৃত্বে এই অভিযান চলবে।
সাউথকম মার্কিন সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড। এর দায়িত্ব দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ৩১টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। সাউথকম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছে, মার্কিন মেরিনরা ক্যারিবিয়ানে ইউএসএস ইও জিমা জাহাজে গোলা নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ চালাচ্ছে। এর লক্ষ্য মাদক পাচার দমন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা।
বৃহস্পতিবার হেগসেথের ঘোষণার আগে খবর পাওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরে ২০তম হামলা চালিয়েছে। এতে চারজন নিহত হয়েছেন। মার্কিন সেনাবাহিনী দাবি করছে, এই হামলাগুলো মাদক পাচারকারীদের টার্গেট করে চালানো হয়। তবে তারা এখনো কোনো প্রমাণ বা আইনি ব্যাখ্যা দেয়নি। এ পর্যন্ত এসব হামলায় প্রায় ৮০ জন নিহত হয়েছেন।
‘অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার’ শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড ভেনেজুয়েলা উপকূলের দিকে রওনা দেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই সেটি সেখানে পৌঁছাবে। দক্ষিণ আমেরিকায় এত বড় সামরিক শক্তির প্রদর্শন বহু দশকে দেখা যায়নি।
এই রণতরির আগমনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক মোতায়েনকে বাহ্যিকভাবে মাদকবিরোধী অভিযান বলা হলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর আসল উদ্দেশ্য ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে চাপ দেওয়া বা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আন্দিজ অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক এলিজাবেথ ডিকিনসন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে তো এতো বড় বিমানবাহী রণতরীর দরকার নেই। তাঁর মতে, এই সামরিক প্রদর্শন মূলত কারাকাসকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
ভেনেজুয়েলার প্রতিক্রিয়া
বুধবার ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে মাদুরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তারা যখন জীবাণু বা রাসায়নিক অস্ত্রের অজুহাত খুঁজে পাচ্ছে না, তখন মাদকের মতো অদ্ভুত গল্প বানাচ্ছে।’
বৃহস্পতিবার মাদুরো সিএনএনে দেওয়া সাক্ষাতকারে শান্তির বার্তা দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার জনগণের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানান এবং মার্কিন তৎপরতাকে আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি বলেন। তিনি লিবিয়া ও আফগানিস্তানের মতো ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের আহ্বানও জানান।
তবে ভেনেজুয়েলাও সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি সামরিক উপস্থিতির ‘সাম্রাজ্যবাদী হুমকি’ মোকাবিলায় প্রায় দুই লাখ সেনা দুই দিনের মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেস বলেন, ক্যারিবিয়ানে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন ভেনেজুয়েলাসহ পুরো অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব ও শান্তির ওপর ‘একটি স্পষ্ট আঘাত’।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ আমেরিকায় শান্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার জনগণের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানান।ভেনেজুয়েলা এরই মধ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতায় আছে। দেশটি প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েন করেছে। সম্ভাব্য হামলার মুখে গেরিলা কৌশলে প্রতিরোধ গড়ার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। মাদুরো শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সংঘাত এড়াতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেছেন।
ভেনেজুয়েলা স্বীকার করে যে প্রচলিত যুদ্ধে তাদের সামরিক শক্তি দুর্বল। তাই তারা গেরিলা কৌশল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশজুড়ে ২৮০টিরও বেশি স্থানে ছোট ছোট ইউনিট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে ২০০০-এর দশকের পুরোনো রুশ বিমান, হেলিকপ্টার, ট্যাংক এবং ৫ হাজার ইগলা ক্ষেপণাস্ত্র আছে।
জাতীয় মিলিশিয়া দাবি করে যে তাদের সদস্য সংখ্যা ৮ মিলিয়ন, যদিও কম বেতন ও সরঞ্জাম ঘাটতির কারণে প্রস্তুতি অসমান। মাদুরো সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে ‘সর্বাত্মক বিদ্রোহী প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়োসদাদো কাবেলো যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব না দিলেও জানিয়েছেন যে ক্ষেপণাস্ত্র দেশের শেষ পাহাড় পর্যন্ত মোতায়েন থাকবে।
মাদক পাচারের অভিযোগ কতটা সত্য
যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে যে মাদুরো সরকারের সঙ্গে মাদক পাচারচক্র ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ জড়িত। এই চক্র যুক্তরাষ্ট্রে কোকেন ও ফেন্টানিল পাচারে ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোর গ্রেফতারে ৫০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। তারা মাদুরো সরকারকে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা ‘অবৈধ শাসক’ বলে আখ্যা দেয়।
অন্যদিকে মাদুরো অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় আগের মতোই সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। পানামা আক্রমণের মতো অতীত উদাহরণ এই অভিযোগকে জোরদার করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী বক্তব্য বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কারণ অধিকাংশ ফেন্টানিল মেক্সিকো হয়ে আসে এবং এর উপাদান আসে এশিয়া থেকে, ভেনেজুয়েলা থেকে নয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি
প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের যুগ (১৯৯৯-২০১৩) থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। চাভেজের সমাজতান্ত্রিক নীতি ও মার্কিনবিরোধী অবস্থান সম্পর্ককে দুর্বল করে। চাভেজের মৃত্যুর পর মাদুরোর সময়েও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও নির্বাচনী প্রশ্নে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো অবৈধ বলে ঘোষণা করে।
অর্থনৈতিকভাবে দেশটি চরম সংকটে আছে। ২০২৫ সালের শেষে মুদ্রাস্ফীতি ২৭০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরে সন্দেহভাজন মাদকবাহী নৌযানে হামলা বাড়িয়েছে।
লাতিন আমেরিকায় এটি ১৯৮৯ সালের পর সবচেয়ে বড় মার্কিন মোতায়েন। এতে ৯০টি বিমানবাহী ক্ষমতাসম্পন্ন জেরাল্ড আর ফোর্ড, মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং পুয়ের্তো রিকোতে স্থলবাহিনী যুক্ত আছে। এতে মোট মার্কিন বাহিনীর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়ায়। রণতরিতে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন সেনা থাকে এবং এর সঙ্গে কয়েকটি ডেস্ট্রয়ার ও ইউএসএস ইও জিমার মতো যুদ্ধজাহাজও অঞ্চলটিতে টহল দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাজ্য মার্কিন হামলায় বেসামরিক প্রাণহানির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় স্থগিত করেছে। রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলাকে সমর্থন বাড়িয়েছে। এতে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হলেও তাৎক্ষণিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কম। দুই পক্ষই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছে। ঘটনাপ্রবাহ মার্কিন নীতির ওপর নির্ভর করে কূটনৈতিক সমাধান বা আরও উত্তেজনার দিকে যেতে পারে।
এই উত্তেজনা বৃহত্তর সংঘাতেও রূপ নিতে পারে। যদিও মাদুরোর বক্তব্যে আলোচনার ইঙ্গিত আছে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো ‘পশ্চিম গোলার্ধকে আমেরিকার অঙ্গন’ হিসেবে বিবেচনা করার নীতি পুনর্ব্যক্ত করছে।
জাতিসংঘ উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানায় এবং মার্কিন হামলাগুলোকে সম্ভাব্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করে। কলম্বিয়া অন্তত ৭৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। জি–৭ দেশগুলোও মার্কিন তৎপরতায় সমালোচনা করে। ইরান ও কিউবাও ভেনেজুয়েলার পাশে রয়েছে। ক্যারিবীয় দেশগুলো পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল কূটনৈতিক আলোচনার আহ্বান জানাচ্ছে। মাদুরোর শান্তির বার্তা সংঘাত এড়াতে একটি পথ তৈরি করতে পারে, যদিও ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক শক্তির সম্পৃক্ততায় পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, সিএনএন